সর্বশেষঃ

আহমদ শরীফের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রকাশ :

‘শিল্পী অভিযাত্রা করেন অনুভূতির নতুন নতুন সমুদ্রে। জ্ঞানে যে বাস্তবলোক আয়ত্ত হয়, তার শক্ত ভূমিতল শিল্পীর পায়ের নিচে থাকে না। শিল্পী অতি অস্থির, উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।’ ক্রিস্টফার কডওয়েলের এই উক্তি যার জীবনের সঙ্গে হুবহু মিলে যায় তিনি বাংলা ভাষার ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের একজন মহান লেখক ও গবেষক অধ্যাপক আহমদ শরীফ। মধ্যযুগের পুঁথিগুলোকে বাংলা ভাষার উপযোগী করার জন্য তিনি গবেষণার ক্ষেত্রে যে নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন, সেই সাধনার কীর্তিস্বরূপ তিনি তার সময়ে বাংলাসাহিত্যের সবচেয়ে বড় পন্ডিত হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। একই সঙ্গে তিনি সৈয়দ সুলতান তার গ্রন্থাবলি ও তার যুগ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।

চট্টগ্রামের পটিয়া থানার অন্তর্গত সুচক্রদন্ডী গ্রামে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ফেব্রম্নয়ারি আহমদ শরীফের জন্ম। তার পিতা আব্দুল আজিজ ও মাতা মিরাজ খাতুন। জন্মের পর তিনি চাচা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের কাছে লালিত-পালিত হয়েছেন। এতে অনেকের ধারণা, তিনি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সন্তান।

আহমদ শরীফ পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, ইন্টামেডিয়েট কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ হতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেন। পেশাগত জীবনে প্রথমে তিনি দুর্নীতি দমন বিভাগে অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই দুর্নীতি দমন বিভাগের চাকরি ছেড়ে তিনি কুমিলস্নায় নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর তিনি ফেনী ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা করেন। ঢাকা বেতারে সহকারী প্রোগ্রাম প্রডিউসারের চাকরি ছেড়ে ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে তার চাচা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সংগৃহীত পুঁথিভান্ডার ও সাময়িক পত্রপত্রিকা সম্ভার বিনা অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করার শর্ত জড়িত ছিল। সাহিত্যবিশারদ শর্তারোপ করেন যে, তার মনোনীত ব্যক্তি আহমদ শরীফকে এই পুঁথি ও পত্রিকাগুলোর সম্পাদনার দায়িত্ব দিতে হবে; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই শর্তে রাজি হন। এ কাজকে জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে আহমদ শরীফ মধ্যযুগের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেন। এ জন্য তার যুক্তি, বিশ্লেষণ, তথ্যের যথাযথ উপস্থাপন ও পান্ডিত্য দিয়ে মধ্যযুগের সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করেন। প্রচলিত ব্যবস্থা ও বিশ্বাস পরিত্যাগ করে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, রাজনীতি, দর্শন ও ইতিহাসসহ নানা বিষয়ে তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন। ড. আহমদ শরীফ যখন বাংলা ভাষা, সাহিত্য, বাঙালি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে কথা বলেন, তখন তার চিন্তা ও কর্মের গূঢ় অনুভূতি, সেই সঙ্গে তার জাতীয়তাবোধের স্পিরিট স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে অস্থায়ী লেকচারার হিসেবে নিয়োগ পান এবং দু’বছর পর থেকে সাংবাদিকতা বিভাগের খন্ডকালীন শিক্ষকও ছিলেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ হতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার সেকশনের দায়িত্বের পাশাপাশি শিক্ষকতাও করেন। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ৩৬ বছরের শিক্ষকতা জীবনে তিনি আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন ছিলেন একাধিক মেয়াদে। এরপর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ‘নজরুল অধ্যাপক পদে’ যোগ দেন।

শিল্পীর স্বাধীনতা প্রশ্নে গ্রন্থে রণেশ দাশগুপ্ত ‘সাহিত্য’ অংশের শুরুতেই লিখেছেন, ‘শিল্পী বললেই আমরা এক বিশেষ ধরনের লোককে বুঝি। কেউ পটুয়া, কেউ নট, কেউ গায়েন, কেউ বা কবি। এরা এক বিশেষ ধরনের কাজ করে, যাকে আমরা বলি শিল্পকলা।… এরা আমাদের মনে রঙ ধরিয়ে দেয়। আমাদের বাসনা, ভয়, ঘৃণা, আশা ইত্যাদি আবেগকে সক্রিয় করে; আমাদের মানবীয় প্রবৃত্তিকে স্পর্শ করে বইয়ে দেন এক নতুন ধারায়। আমাদের সরু মোটা অনুভূতি নিয়ে এদের কারবার। পাথরে হোক, রঙে রেখায় অক্ষরে হোক, তার বা টানা চামড়ায়, অথবা কুমড়োর খোলে হোক, শিল্পী অভিন্ন এদিক দিয়ে যে এরা সবাই আমাদের প্রবৃত্তি, আবেগ ও অনুভূতিতে দোলা দেয়, ঘুম পাড়ায়, নাচায়, সক্রিয় করে।’ আহমদ শরীফের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। তিনি বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে পঞ্চাশের দশক থেকে আমৃতু্য লিখেছেন। সেই সঙ্গে সংস্কারমুক্ত একটি বৈষম্যহীন সামাজিক রাষ্ট্রের চিন্তাই তার লেখায় উঠে এসেছে বারবার। আরব সমাজে প্রচলিত আছে, ‘কোনো জাতিতে একজন বড় কবির জন্ম হচ্ছে সেই জাতির পরম সৌভাগ্য।’ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একজন আহমদ শরীফের জন্ম অবশ্যই বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতির জন্য আশীর্বাদ।

ড. আহমদ শরীফের মনীষা বুঝতে হলে তার রচিত গ্রন্থগুলো পাঠ করতে হবে। এই গ্রন্থগুলোতে আছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ্‌, মুহম্মদ এনামুল হক, মুহম্মদ আবদুল হাই, আবুল মনসুর আহমদ, জসীমউদ্দীন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, অন্নদাশঙ্কর রায়, হাসান হাফিজুর রহমান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, রণেশ দাশগুপ্ত, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুর রাহমান, শওকত ওসমান, শহীদুলস্নাহ কায়সার, আলতাফ মাহমুদ, জহির রায়হান, অজয় রায়, খান আতাউর রহমান, আবুদুলস্নাহ আল মামুনসহ যেসব কবি-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক-মনীষীর নাম প্রসঙ্গক্রমে সামনে আসে তাদের মধ্যে ড. আহমদ শরীফ স্বতন্ত্র এবং সম্পূর্ণরূপে সংস্কারমুক্ত ব্যক্তিত্ব। তার সমগ্র লেখায় আছে বাঙালি ও বাংলাদেশ।

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে (সম্প্রদায়ভিত্তিক) পাকিস্তান ও ভারত প্রতিষ্ঠা ছিল ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত। সেই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে গোটা উপমহাদেশকে। ভারত-পাকিস্তান বৈরীভাব, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। ভারতে হিন্দু-উগ্রবাদের উত্থান, পাকিস্তানে বিরাজমান গণবিরোধী রাজনীতি ও সামরিক প্রভাব। একইসঙ্গে কাশ্মিরসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের উত্তেজনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *