সর্বশেষঃ

করোনা ছাড়াও যে চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে

করোনাভাইরাসের হামলা প্রতিরোধে বর্তমান সরকার যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন আরও একটি চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এটা করোনাভাইরাসের চাইতে কম বিপজ্জনক চ্যালেঞ্জ নয়। এই চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে করোনায় বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অভিজিত ব্যানার্জি ও এস্থার ডাফলোর মতে, ‘এ কাজটা উন্নত দেশগুলোর জন্য যতটা সহজ হবে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তত সহজ হবে না।’ বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা ধারা তৈরি হয়েছিল। করোনা সেই ধারায় বড় রকমের ধাক্কা দিয়েছে। এই ধাক্কা সামলানো হবে হাসিনা সরকারের জন্য দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ।

করোনা আমলের আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন, সোশ্যাল ডিসটেন্সের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাজ কাঠামো পুনর্গঠনে সমস্যা দেখা দেবে বেশি। যেমন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতেই সমাজ কাঠামো বেশি বদলে গিয়েছিল। এবার করোনার বিশ্বগ্রাসী হামলার পর এদেশগুলোর সামাজিক পাটাতন আগের মতো থাকবে না। বাংলাদেশেও থাকবে না। সমাজের জন্য নতুন পাটাতন গড়ারও দায়িত্ব পালন করতে হবে বর্তমান হাসিনা সরকারকেই। এটাও হাসিনা সরকারের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা সরকারকে অবশ্যই করতে হবে।

এরপরেও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ থাকবে। সে চ্যালেঞ্জ হলো কুম্ভকর্ণের মতো দীর্ঘ করোনাকালীন নিদ্রাভঙ্গের পর বিএনপি, সুশীল সমাজ, জাসদ, বাসদ, সিপিবির পুনর্জাগরণ এবং করোনা ঠেকাতে সরকারের ব্যর্থতার দীর্ঘ তালিকা তৈরি করে সরকারকে একযোগে আক্রমণ। সরকারের করোনাবিরোধী ব্যবস্থাপনায় বেঁচে থাকার পর বিরাটসংখ্যক আক্রান্ত ও মৃতদের প্রতিনিধি সেজে এরা সরকারের সব সাফল্যকে ব্যর্থ প্রমাণের জন্য চিৎকার শুরু করবে। বিএনপি ও তথাকথিত সুশীল সমাজের হাতে কোন রাজনৈতিক ইস্যু নেই। তারা করোনার দীর্ঘকালীন হামলাকেই রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে এই এত বড় বিপর্যয়ের ধাক্কা যে সরকার সাহসের সঙ্গে সামলেছে সে কথা স্বীকার না করে প্রচার চালাবে এবং নানা রকম গল্প বানাবে। ইতিমধ্যেই ঘরে বসে তারা সেটা শুরু করেছে দেখে একথাটা বলছি।

জাতীয় বিপর্যয়ের সময় দরকার হয় জাতীয় ঐক্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় চার্চিলের নেতৃত্বে ব্রিটেনের ডানবাম সকল দল মিলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছিল নাৎসিদের রোখার জন্য। করোনা নাৎসিদের চাইতেও বড় শত্রু। এই শত্রুকে রোখার জন্য আমাদের আরও বড় জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। করোনা প্রতিরোধে সকলেই যাতে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সেজন্য নাগরিক সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ গড়ে তোলার জন্য সব রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত একটা বড় ভূমিকা পালন করা।

বাংলাদেশে যে আবার নতুন করে করোনা ছড়াচ্ছে, তার বড় কারণ, করোনার সমস্যা দূরীভূত হওয়ার আগেই লকডাউন কার্যত ভেঙ্গে পড়েছে। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোর অধিকাংশই খুলে দেওয়া হয়েছে। দিনমজুরেরা আর কতদিন ঘরে বসে থাকবে। তারা কাজের খোঁজে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। পুলিশ দিয়ে আর কতদিন তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে? এখানেই আসে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্তব্য পালনের কথা। করোনার অজুহাতে তারা প্রায় সকলেই এখন নিষ্ক্রিয়। এমনকি ড. কামাল হোসেনের নিয়মিত সারমনগুলো থেকেও জাতি বঞ্চিত। এ সময় ঘরে বসে সাধারণ মানুষের মধ্যে নাগরিক দায়িত্ববোধ জাগানোর জন্য সারমন দিলে তিনি জাতির প্রতি একটা বড় দায়িত্ব পালন করতেন। এই একটা সময়, যখন শেখ হাসিনার দিকে সহযোগিতা ও সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেওয়া ছিল তাদের একটা বড় দায়িত্ব পালন।

করোনার প্রকোপ না কমে যেভাবে বাড়ছে, তাতে কষ্ট হলেও আরও কিছুদিন আইসোলেশনে থাকা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্দিষ্ট করে দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি আমাদের মেনে চলতেই হবে। দরিদ্র মানুষ যাতে তা মেনে চলতে পারে সেজন্য হাসিনা সরকার বেশ কয়েকটি সাহায্যের প্যাকেজসহ দেড় কোটি মানুষের জন্য খাদ্য সাহায্যের ব্যবস্থা করেছে। সরকার আর করবে। কিন্তু মানুষের দরকার সরকারের সব রকম বিধি ব্যবস্থা মেনে চলা। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই বিধিনিষেধ মেনে চলার মতো নাগরিক সচেতনতা খুব কম। রাজনৈতিক দলগুলোর এখন বড় দায়িত্ব সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা। এ জন্য জনসভা করার দরকার নেই। তারা ঘরে বসেই বাণী, বিবৃতি, প্রচারপত্রের সাহায্যে এ কাজটি করতে পারেন।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্যারিস দখলের পর হিটলারের সেনাবাহিনী যখন ইংলিশ চ্যানেলের অপর পারে এসে পৌঁছায় এবং প্রতিঘণ্টায় লন্ডনে চলছে অন্তত পাঁচবার ভি-রকেট হামলা, তখন বিভিন্ন সরকারী বিধিনিষেধ মেনে চলার জন্য সকল রাজনৈতিক দলের প্রচারপত্রে লন্ডনের দেয়াল ছেয়ে গিয়েছিল। সরকার এ সময় নির্দেশ জারি করেছিল, রাতে বোমা হামলার সাইরেন বাজার সময় ঘরে বা ঘরের বাইরে কেউ আলো জ্বালাতে পারবে না। আলোর নিশানা পেলে নাৎসি বোমারু বিমানগুলোর বোমা ফেলতে সুবিধা হয়। পুলিশ যাতে এদিকে লক্ষ্য রাখে সেজন্য তাদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

একরাত্রে প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ছিলেন ঘরের বাইরে। এই সময় লন্ডনে হিটলারের বিমান হামলার সাইরেন বেজে ওঠে। চার্চিল তাড়াতাড়ি গিয়ে একটি ভূগর্ভস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে আরও অনেকের মতো আশ্রয় নেন। চার্চিল সব সময় ঠোঁটে একটি তামাকের পাইপ রাখতেন। সে রাতে তার পাইপের তামাকের আগুন নিভে গিয়েছিল। তিনি রাতে আগুন না জ্বালানোর সরকারী নির্দেশ ভুলে গিয়ে দেশলাই বের করে পাইপে আগুন ধরান। ওই ভূগর্ভস্থ শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছিলেন এক কনেস্টবলও। তিনি অন্ধকারে চার্চিলকে চিনতে না পেরে তার হাত ধরে ফেলে এবং বলেন, আইন ভাঙ্গার জন্য তোমাকে আমি গ্রেফতার করলাম।

চার্চিল বাধা না দিয়ে গ্রেফতার বরণ করেন। অল ক্লিয়ার সাইরেন বেজে উঠলে আবার আলোও জ্বলে ওঠে। কনস্টেবল প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে গ্রেফতার করেছেন দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। চার্চিল তাকে অভয় দিলেন। কনেস্টবলের সঙ্গে থানায় গেলেন। থানা কর্তৃক নির্দিষ্ট জরিমানা দিলেন। সেই সঙ্গে কনেস্টবলকে তার কর্তব্যপরায়ণতার জন্য পুরস্কৃত করেন। আমি ভাবি, এই ঘটনাটি তো বিলাতে ঘটেছে। যদি আমাদের দেশে ঘটত? পুলিশ কোন মন্ত্রীকে কেন, মন্ত্রীপুত্রকেও গ্রেফতার করলে পরিণতি কী হতো তার অসংখ্য উদাহরণ কি এদেশে নেই?

আইন করা সহজ। কিন্তু তা মেনে চলা এবং অন্যের দ্বারা তা মানানো কঠিন। বিশেষ করে জনবহুল উন্নয়নশীল দেশে তা আরও কঠিন। কারণ, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দীর্ঘদিনের অশিক্ষা, কুসংস্কারের জন্য নাগরিকদের মধ্যে নাগরিক দায়িত্ব পালনের সচেতনতার অভাব। এই অভাব দূর করার দায়িত্ব দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক দলগুলোর। এ সময় আমাদের মধ্যে দরকার ছিল একজন স্যার গুরুসদয় দত্তের আবির্ভাব। যিনি অবিভক্ত বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া মহামারী আকারে দেখা দিলে বয়স্কাউট গঠন করে মশক ধ্বংস অভিযানে নেমেছিলেন।

একটু আগেভাগেই কথা বলি। করোনা আজ হোক আর কাল হোক যাবে। তারপর অথবা করোনার উপস্থিতিতেই আসবে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, এই মন্দা উন্নত-অর্ধউন্নত, অনুন্নত সব দেশকেই ত্রিশের মন্দার চাইতেও ভয়াবহভাবে আঘাত করবে। আঘাতটা বেশি পড়বে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর মাথায়। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। তাই এই মন্দার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশকে এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।

এক্ষেত্রে একটাই আশার কথা, বাংলাদেশে এবার কৃষিফলন ভাল হয়েছে। বৃষ্টির মৌসুম পুরোপুরি আসার আগেই জমির ফসল ঘরে তোলার কথা প্রায় সারা হয়ে গেছে। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, করোনাপরবর্তী খাদ্য সঙ্কটের মোকাবেলা বাংলাদেশ ভালভাবে করতে পারবে। ফলে বাংলাদেশ অর্থনীতির সামগ্রিক মন্দা মোকাবেলায় ব্যর্থ হবে না। এ কথা বলেছে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাও। বলেছে, যেসব দেশ দ্রুত অর্তনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠবে তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। শেখ হাসিনার দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ করোনা এবং অর্থনৈতিক মন্দা দুটি চ্যালেঞ্জই ভালভাবে মোকাবেলা করতে পারবে বলে আমারও ধারণা। আর তা যদি হয়, হাসিনা সরকারের জন্য যে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের আশঙ্কা আমি করছি, তা আষাঢের কালো মেঘের মতো আকাশে জমতে না জমতেই গলতে শুরু করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *