সর্বশেষঃ

ডলার ও রাজনীতিঃ শারল ডা গল- ডলারের বিরুদ্ধে মানবতার পক্ষে বিংশ শতাব্দীর প্রথম যোদ্ধা

এটা আজ পরিষ্কার ডলার কেন্দ্রিক অর্থ ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকার ফলে পৃথিবীর অভিজাতদের সম্পদ ও ক্ষমতার মাত্রা অসীমে এসে পৌঁছেছে। এটা ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে, যতক্ষণ পৃথিবীর মানুষ এই দস্যু ব্যারনদের আঁকা ছক অনুসারে চলবে।

পুরো পৃথিবীর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা আর সকল দেশের কাছে ছড়িয়ে গেলো। ১৯৪৩ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞগণ একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করে। তখন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ পুরোদমে চলছে। যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন, এবং হিটলার বিরোধী জোটের অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো আমেরিকার কাছ থেকে স্বর্ণের বিনিময়ে বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র, ধাতব পদার্থ, যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ এবং খাদ্য ক্রয় করত। যুদ্ধের সময় প্রচলিত ব্যাংক নোটের কোন মূল্য তখন ছিল না। ডলার তখন মূল্যবান ধাতুর সাথে সমতুল্য হয়ে গিয়েছিলো, এবং ডলারকে “স্বর্ণমান” বা “গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড” প্রদান করা হয়।
এখানে কিছু উপাত্ত দেয়া হলোঃ ১৯৩৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ১৩০০০ টন স্বর্ণ মজুদ ছিল, ১৯৪৫ সালে তা হয় ১৭৭০০ টন এবং ১৯৪৯ সালে তা বেঁড়ে দাঁড়ায় ২১৮০০ টনে, যা বলা যায় তখনকার পৃথিবীর সম্পূর্ণ স্বর্ণ মজুদের প্রায় ৭০ শতাংশ।

৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৫। এক নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি জেনারেল শার্ল দ্য গোল (ফরাসি: Charles André Joseph Marie de Gaulle) সাংবাদিকদের বলেন, “এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, স্বর্ণমানের বিপরীতে অন্য কিছু চিন্তা করা অসম্ভব। বৈদেশিক লেনদেনের একমাত্র যৌক্তিক মূলনীতি হচ্ছে স্বর্ণমান, যাকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। একমাত্র স্বর্ণমানের মাধ্যমে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখা সকলের জন্য অবশ্য করনীয় একটি বিষয়।”
পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা যখন তার বক্তব্য সমাপ্ত করলেন, তখন সাংবাদিকরা সবচেয়ে নিকটস্থ টেলিফোন সেটের নিকট ছুটে গেলেন। সবাই বুঝতে পারলো, মার্কিন ডলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। ডা গল যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ডলার কেন্দ্রিক বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে তাগিদ দিলেন। তিনি বিশ্ব যুদ্ধ পূর্ববর্তী লেনদেন ব্যবস্থা পুনরায় স্থাপন করতে মতামত দেন। অন্য ভাষায়, তিনি চিরায়তকালের স্বর্ণমান ফিরিয়ে আনতে মত দেন, যেখানে সকল মুদ্রার মান স্বর্ণের বিপরীতে ঠিক করা হবে।
ডা গল লেনদেন করার জন্য স্বর্ণ ফিরিয়ে আনতে বলেননি, বরং মুদ্রা ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য স্বর্ণমান ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। আমেরিকানরা তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ আর ক্যারিবিয় উপকূলের সমস্যার মধ্যে জর্জরিত ছিল, তারা আশা করলো যে ফরাসি রাষ্ট্রনায়কের ডলার বিরোধী মন্তব্য যেন শুধু রাজনৈতিক বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অবশ্য, ব্যাপারটি সেভাবে থাকেনি।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রবার্ট ট্রিফিন এবং জ্যাকুয়েস রফ ১৯৫৯ সালে একটি গোপন প্রতিবেদনের মাধ্যমে জেনারেল শারল ডা গল কে অভিহিত করেন যে, ফ্রান্সকে জোর করে এই “গোল্ড পুল” এ অন্তর্ভুক্ত করার ফলে ফ্রান্সের অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে। নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের আন্তর্জাতিক কাঠামো ৭টি পশ্চিমা ইউরোপীয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রয়েছে, যার মধ্যে ফ্রান্স অন্যতম। এই ব্যাংকগুলো লন্ডনের ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ওয়াশিংটনের সুবিধার জন্য স্বর্ণের দাম আউন্স প্রতি ৩৫ ডলার রাখাই এদের একমাত্র কাজ ছিল না (১ আউন্স = ৩১ গ্রাম), বরং নিজেদের লাভের জন্য সেই মজুদকৃত স্বর্ণের মাধ্যমে তারা ব্যবসাও করত, এবং একটি মাসিক প্রতিবেদন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের নিকট পৌঁছে দিত। তাদের স্বর্ণ বিক্রয়ের আকার বাঁড়াতে এই “গোল্ড পুল” তাদের মজুদ থেকে স্বর্ণ আমেরিকানদের হাতে তুলে দিত। যদি এই “পুল” বিক্রয়ের চেয়ে বেশি স্বর্ণ কিনত, তবে পার্থক্যটি অপমানজনক অনুপাতের মাধ্যমে ভাগ করে দেয়া হতঃ অর্ধেক আমেরিকানদের জন্য, বাকি অর্ধেক অন্যদের জন্য। ফ্রান্সের ছিল ৯ শতাংশ। বিশেষজ্ঞগণ ডা গলকে জানান যে এই “গোল্ড পুল” ইউরোপিয়ানদের ৩ বিলিয়ন ডলারের ওপর ক্ষতি করেছে।
ডা গল জানতেন যে তার আচরণে আমেরিকা ভীষণ বিরক্ত হয়েছে, বিশেষ করে ১৯৬০ এর দশকের শুরুতে ফ্রান্স তার নিজের পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়নের কার্যক্রম গতিশীল করেছিলো। ১৯৬৩র জানুয়ারিতে ডা গল পেন্টাগনের তৈরি “বহুজাতিক পারমাণবিক সমরাস্ত্র বাহিনী” কে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ন্যাটোর কাছ থেকে ফ্রান্সের আটলান্টিক নৌবহর ফিরিয়ে নেন। সেই সময় পর্যন্ত আমেরিকার অধীনে আগে থেকে স্থির করা ১৪ ডিভিশনের বদলে মাত্র ২ ডিভিশন ফ্রেঞ্চ সৈন্য রেখে দেয়া হয়। অবশ্য, আমেরিকানরা কখনোই আশংকা করেনি যে এটা কেবল শুরু।
১৯৬৫ সালে শারল ডা গল আনুষ্ঠানিক ভাবে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি লিন্ডন জন্সনের নিকট ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার স্বর্ণের মাধ্যমে পরিশোধ করার দাবি তোলেন, যা মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভে গচ্ছিত রাখা ছিল। ওয়াশিংটন এর উত্তরে জানায় যে, ফ্রান্সের এই পদক্ষেপ মোটেও বন্ধুসুলভ নয় এবং এর পরিণতি ভালো হবে না। “রাজনীতি এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেটা রাজনীতিবিদদের হাতে ছেঁড়ে দেয়া যায় না।” কথাটি বলেই জেনারেল শারল ডা গল ফ্রান্সকে ন্যাটো থেকে প্রত্যাহার করে নেন।
১৯৬৫ এর বসন্তে একটি ফ্রেঞ্চ জাহাজ নিউ ইয়র্কে নোঙ্গর ফেলে। এটা কোন যুদ্ধ জাহাজ ছিল না, কিন্তু এই জাহাজে একটি অস্ত্র ছিল যা ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক যুদ্ধে জয়ী হতে ব্যবহার করতে চাচ্ছিল। এই ফ্রেঞ্চ জাহাজে ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণের ব্যাংক নোট নিয়ে আসা হয়েছিলো, যা “আসল টাকার” মাধ্যমে বিনিময় করে নেয়া হবে, যা হচ্ছে স্বর্ণ। এটি ছিল ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের জন্য প্রথম কিস্তির পরিমাণ।
“সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়েছে, ব্যাংক অফ ফ্রান্সের প্রতিনিধি ইউএস ট্রেজারির নিকট প্রতিশ্রুত অর্থের অর্ধেক তুলে দিতে তৈরি আছেন, টাকা এখানে চলে এসেছে।” প্যারিস থেকে এমন বার্তা ওয়াশিংটনের নিকট চলে আসে। “গোল্ড পুল” এর মাধ্যমে এরকম লেনদেন শুধু মাত্র ইউএস ট্রেজারির মাধ্যমেই সম্ভব ছিল। প্রথম ফ্রেঞ্চ “টাকার” জাহাজ তার খোলের মধ্যে ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খালাস করার জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। মার্কিন মুদ্রার মাধ্যমে স্বর্ণ গ্রহণের বিনিময়ের হারটি ফ্রান্সের জন্য খুবই লাভজনক ছিল, প্রতি ডলারের বিনিময়ে ফ্রান্স ১.১ গ্রাম স্বর্ণ পেয়েছিল। এবং ৮২৫ টন স্বর্ণ খুব ছোটখাট পরিমাণ নয়। আরও একটি জাহাজে একই পরিমাণ অর্থ নিয়ে আসা হচ্ছিলো, এবং এটি ছিল একটি সূচনা। ১৯৬৫র শেষে এসে আমেরিকায় ফ্রেঞ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৫.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে নেমে মাত্র ৮০০ মিলিয়ন ডলারে এসে পড়ে।
অবশ্যই, ডা গল একা ডলারকে টেনে নামাননি। তারপরও, ফ্রান্সের এধরণের হস্তক্ষেপ আমেরিকার জন্য একটি বিপদজনক নজির তৈরি করে। ফ্রান্সের তরফ থেকে এরকম অনিশ্চিত পদক্ষেপ আসার ফলে, ঈর্ষান্বিত জার্মানরাও তাদের সকল ডলার আমেরিকা থেকে স্বর্ণের বিনিময়ে ফিরিয়ে আনে, এবং তাদের বিনিময়ের পরিমাণ ফ্রান্সের থেকে ১.৫ বিলিয়ন ডলার বেশি ছিল। এধরণের খেলার চালে আমেরিকানরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু এই “সবুজ কাগজগুলো” স্বর্ণের বিনিময়ে গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তারপরে অন্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গুলো, যেমন কানাডা, জাপান একই পথে হাঁটল। আমেরিকার স্বর্ণ মজুদের খবর সে সময় যেন যুদ্ধের ময়দানের প্রথম সারির খবরের মত শোনাতে লাগলো।
১৯৬৮র মার্চে আমেরিকানরা ডলারকে স্বর্ণের মাধ্যমে এরকম সহজ বিনিময় সীমিত করে ফেললো প্রথমবারের মত। ১৯৭১ সালের জুলাইয়ের শেষলগ্নে মার্কিন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিলো যে তাদের নিকট স্বর্ণের মজুদ ইতিহাসের সর্বনিম্ন স্তরে এসে পৌঁছেছে, যা ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও কম। এই সময়ে “নিক্সন শক” এর আগমন। ১৫ আগস্ট, ১৯৭১। মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচারড নিক্সন টেলিভিশনে প্রচারিত এক ভাষণে ঘোষণা দেন যে ডলার আর স্বর্ণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না।
সেই সময় থেকেই মূলত বিশ্বের মুদ্রাগুলো এরকম আর্থিক পিরামিডের মূলনীতি অনুসারে কোনরূপ বাঁধা বিপত্তি ছাড়াই চলতে থাকলো। প্রসঙ্গক্রমে, মার্কিন অর্থনীতি তখনো পুরোপুরি ভাবে এই ব্যাপক হারে স্বর্ণ প্রত্যাহারের পরবর্তী দূরবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি।
এরকম ব্যাপক কর্মযজ্ঞের পর ডা গল ক্ষমতায় বেশি দিন থাকতে পারেননি। ১৯৬৮ সালে এক বড় ধরণের ছাত্র ফ্রান্সে ছড়িয়ে পড়ে। এবং ১৯৬৯ সালের ২৮ এপ্রিলে মেয়াদ শেষ হবার আগেই ডা গল পদত্যাগ করেন। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে ব্যাংকাররা সবসময় যুদ্ধ ও বিপ্লবকে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্যবহার করে থাকে, সুতরাং এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, ডা গলের মত ব্যক্তিত্বের ক্ষমতা থেকে বিদায় কাদের জন্য সুসংবাদ হয়ে এসেছিলো।

পারকিন্স তাঁর লেখা “দ্য নিউ কনফেশন্স অফ অ্যান ইকনোমিক হিটম্যান” নামক বইয়ে এসকল বিষয় এবং আরও অন্যান্য বিষয় আরও বিশদভাবে বর্ণনা করেন। তাঁর বই এসমস্ত ক্ষমতাবান কুশলীদের নোংরা খেলা ও তাদের আক্রমণাত্মক আচরণ আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ জিইয়ে রাখতে ব্যবহার করে তার স্বরূপ ও প্রকৃতি উন্মোচন করেছে।

Eschatology থেকে অনুলিখন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *