সর্বশেষঃ

ধনাঢ্য পরিবারের নারীদের কাছে ছেলে সরবরাহ করতেন মৌ-পিয়াসা

মডেল মরিয়ম মৌ’কে নিয়ে বের হয়েছে চাঞ্চল্যকর নানান তথ্য। ৪৩ বছর বয়সী মৌ ফার্স্ট ফাইন্যান্স নামের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক একেএম ফয়সাল আহমেদ চৌধুরীর চতুর্থ স্ত্রী। মোহাম্মদপুরের  ২২/৯ বাবর রোডের বাসায় থাকতেন। বাসাটি তার স্বামী ফয়সালের। এ বাসা থেকে মৌ মাদক বিক্রিসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। এছাড়া তিনি ঢাকার ধনাঢ্য পরিবারের নারীদের কাছে টাকার বিনিময়ে ছেলে সরবরাহ করতেন। 

ফয়সালকে বিয়ে করার আগে মৌ আরও ১১টি বিয়ে করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রত্যক স্বামীকে মোটা অংকের কাবিনে বিয়ে করেন। সুযোগ বুঝে তালাক দিয়েছেন। তার আগে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। মূলত টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়ার জন্য বিয়ের ফাঁদও পাতেন। সাইবার সূত্র জানিয়েছে, পিয়াসা ও মৌ একই চক্রের সদস্য। দীর্ঘদিন ধরে তাদের মধ্য সখ্য। তারা ব্ল্যাকমেইলিংয়ের জন্য একটি সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে তুলেছিলেন। তাদের চক্রে একাধিক সদস্য রয়েছে। প্রত্যকেরই আলাদা আলাদা কাজ ছিল।

ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা এক আলোচিত নাম। বিভিন্ন কারণে তিনি আলোচনায় এসেছেন বেশ কয়েকবার। পিয়াসা ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। এনটিভি’র রিয়েলিটি শো ‘সুপার হিরো সুপার হিরোইন’র অন্যতম প্রতিযোগী ছিলেন পিয়াসা। কাজ করেছেন এশিয়ান টেলিভিশনের পরিচালক এবং প্রিভিউ কমিটির প্রধান হিসেবে। ২০১০ সালের পরে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে শাফাত আহমেদের সঙ্গে তিনি প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। 

২০১৫ সালের ১লা জানুয়ারি শাফাতকে ১ টাকা কাবিনের বিনিময়ে বিয়ে করে আলোচিত হন। তারপর ২০১৭ সালে রাজধানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনায় আলোচিত হন মডেল পিয়াসা। ওই ঘটনায় তার স্বামী শাফাত ছিলেন নাটের গুরু। এ বছর আবারও আলোচনায় আসেন পিয়াসা। গুলশানের অভিজাত ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়া নামে এক তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর পরিবারের পক্ষ থেকে যে মামলা দায়ের করা হয়, তাতেও পিয়াসার নাম রয়েছে। সর্বশেষ ব্ল্যাকমেইলিং করে টাকা হাতিয়ে নেয়া ও বাসায় সিসা লাউঞ্জ ও মাদক রাখায় গ্রেপ্তার হয়ে ফের আলোচনায় আসেন।

ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম মৌ দু’জনই কথিত মডেল। নামের সামনে মডেল শব্দটি যুক্ত থাকলেও মডেলিং জগতে তাদের তৎপরতা তেমন একটা নেই। চেহারার লাবণ্য আর শারীরিক সৌন্দর্যকে পুঁজি করে তারা হেঁটেছেন ভিন্ন পথে। ঢাকার বিত্তশালীদের কৌশলে প্রেমের ফাঁদে ফেলতেন। বাসায় পারিবারিক পার্টির কথা বলে টার্গেট করা ব্যক্তিদের ডেকে নিতেন। সুযোগ বুঝেই রূপের আড়ালের আসল মানুষটাকে চেনাতেন। বাসায় আমন্ত্রিত অতিথিকে ফাঁদে ফেলে বস্ত্রহীন ছবি-ভিডিও তুলে রাখতেন।

তারপর সেগুলো ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে করতেন ব্ল্যাকমেইলিং। আদায় করতেন লাখ লাখ টাকা। কাঙ্ক্ষিত টাকা উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত চলে এই পন্থা। এভাবে পিয়াসা ও মৌ দীর্ঘদিন ধরে তাদের রংমহলে ডেকে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে ব্ল্যাকমেইলিং করে আসছিলেন। হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। অবশেষে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ কথিত এই দুই মডেলকে গ্রেপ্তার করেছে।

রোববার গভীর রাতে ঢাকার অভিজাত এলাকা বারিধারার ৯ নম্বর সড়কের একটি বাসা থেকে পিয়াসাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি’র সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। এ সময় পিয়াসার বাসার টেবিলে অভিযানিক দল চার প্যাকেট ইয়াবা, রান্নাঘরের ক্যাবিনেট থেকে ৯ বোতল বিদেশি মদ, ফ্রিজে একটি আইসক্রিমের বাক্স থেকে সিসা তৈরির কাঁচামাল এবং বেশ কয়েকটি ই-সিগারেট পাওয়া গেছে। এছাড়া পিয়াসার কাছ থেকে ৪টি স্মার্টফোন জব্দ করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। পিয়াসাকে আটকের পর অভিযানিক দল মোহাম্মদপুরের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে মরিয়ম মৌ’কে আটক করে। তার বাসায় অভিযান চালিয়ে অভিযানিক দল মদের বারের অস্তিত্ব পায়। এছাড়া ৭৫০ পিস ইয়াবাও উদ্ধার করা হয় তার বাসা থেকে।

ডিবি’র সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম সূত্র জানিয়েছে, দু’জনই রাতের রানী ছিলেন। তারা দিনভর ঘুমাতেন আর রাতের বেলা রঙ্গমহল সাজাতেন। তাদের রঙ্গমহল পরিচালনার জন্য বেশ কয়েকজন সহযোগী ছিল। তারা সবাই একই চক্রের সদস্য। ব্ল্যাকমেইল করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। পিয়াসা বারিধারায় একাই একটি অভিজাত ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতেন। সন্ধ্যার পর থেকে তার ফ্ল্যাটে চলতো পার্টি। ডিজে গানের তালে তালে স্বল্প বসনা হয়ে পিয়াসা নাচতেন। আমন্ত্রিত অতিথিদের মাঝে আনন্দ বিলিয়ে দিতেন। নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা অতিথির সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতেন। আর এসব দৃশ্য ধারণ করে রাখতেন তার সহযোগীরা। সাইবারসূত্র জানিয়েছে, পারিবারিক পার্টির নামে এসব আয়োজন চলতো। পার্টিতে বিদেশি মদ, ইয়াবা থাকতো। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে মাদক সংগ্রহ করে রাখতেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পিয়াসা ও মৌ দু’জনই গ্ল্যামার্স গার্ল। কিছুদিন মিডিয়া অঙ্গনে থাকার জন্য মোটামুটি পরিচিতি ছিল তাদের। এছাড়া তারা দু’জনের গ্ল্যামার্স থাকার কারণে অনেকেই তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইতেন। তারাও কাউকে নক করলে যে কেউ তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেত। এর বাইরে তারা কিছু লোককে টার্গেট করে কাজ করতেন। চক্রের পুরুষ সদস্যরা কিছু লোককে টার্গেট করে তাদের ফেসবুক আইডি, মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করতেন। পরে এসব আইডিতে বন্ধু হবার প্রস্তাব পাঠাতেন। অনেক সময় মোবাইল নম্বরে রং নম্বর বলে ফোন দিয়ে পরিচয়ের সূত্রপাত করতেন। কারো সঙ্গে পরিচিত হলে অল্প সময়ের মধ্যেই সখ্য গড়ে তুলতেন। তারপর পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের বাসায় পার্টিতে আমন্ত্রণ জানাতেন। পরিকল্পিত সেই পার্টিতে নাচ-গানের ব্যবস্থা থাকতো। অতিথিকে মদ খাইয়ে মাতাল করা হতো। অনেক সময় নেশাদ্রব্যের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে দেয়া হতো। তারপর অচেতন অতিথির সঙ্গে পিয়াসা-মৌ অন্তরঙ্গভাবে দাঁড়িয়ে শুয়ে ছবি ভিডিও করাতেন। আবার অনেক সময় তাদের হেফাজতে থাকা অন্যান্য নারীদের দিয়ে একই কাজ করাতেন। অভিযানের সময় পিয়াসা ও মৌ-এর মোবাইল থেকে অন্তরঙ্গ অনেক ভিডিও ও ছবি উদ্ধার করা হয়েছে।

সাইবার সূত্র আরও জানিয়েছেন, পিয়াসা ও মৌ শুধু প্রেমের ফাঁদে ফেলে বাসায় ডেকে বিভিন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্ল্যাকমেইল করতেন না। তারা দু’জন পুরুষের কাছে টাকার বিনিময়ে নারী ও বিভিন্ন ধনাঢ্য ঘরের নারীদের কাছে পুরুষ সরবরাহ করতেন। এই কাজ করে তারা লাখ লাখ টাকা কামিয়েছেন। সরবরাহ করার জন্য তাদের কাছে অনেক নারী পুরুষ ছিল।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি-উত্তর) যুগ্ম কমিশনার হারুন-অর-রশীদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পিয়াসা ও মৌ দু’জনই একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে আমরা অনেক ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ পেয়েছি। সেসব ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে আজ তাদের বাসায় অভিযান চালানো হয়। দু’জনের বাসায় বিদেশি মদ, ইয়াবা ও সিসা পাওয়া গেছে। মৌ-এর বাড়িতে মদের বারও ছিল। তিনি বলেন, আটক দুই মডেল হচ্ছেন রাতের রানী। তারা দিনের বেলায় ঘুমান এবং রাতে এসব কর্মকাণ্ড করেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পার্টির নামে বাসায় ডেকে আনতেন তারা। বাসায় এলে তারা তাদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি-ভিডিও ধারণ করে রাখতেন। পরবর্তীতে তারা সেসব ভিডিও ও ছবি ভিক্টিমদের পরিবারকে পাঠাবে বলে ব্ল্যাকমেইল করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিতেন।

এদিকে পিয়াসা ও মৌ-এর বিরুদ্ধে ডিবি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দু’টি মামলা দিয়েছে। মোহাম্মদপুর থানায় মৌ-এর বিরুদ্ধে আর গুলশান থানায় পিয়াসার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এছাড়া গতকাল বিকালে দু’জনকে আদালতে হাজির করে রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা। পরে আদালত দু’জনের তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।