সর্বশেষঃ

পুরো এক রাত বাঙ্কারে কাটালেন ট্রাম্প

হোয়াইট হাউসের সামনে ২৯ মে রাতে বিপুলসংখ্যক জনতা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করলে, সিক্রেট সার্ভিসের কর্মীরা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউসের নিচে থাকা বাঙ্কারে নিয়ে যান। পুরো রাত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই বাঙ্কারেই কাটিয়েছেন।

ছবি: রয়টার্স

বর্ণবাদবিরোধী ক্ষুব্ধ মানুষের উত্তাল আন্দোলন থামছে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমেরিকার অন্তত ৪০টি নগরীতে কারফিউ জারি করতে হয়েছে। বিক্ষোভ দমনে স্থানে স্থানে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়েছে। গত ২৯ মে রাতে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। হোয়াইট হাউসের উত্তর গেট থেকে বোতল ও ইটপাটকেল ছোড়ার সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ছিলেন। রাতে সিক্রেট সার্ভিসের কর্মীরা তাঁকে হোয়াইট হাউসের নিচে থাকা বাঙ্কারে নিয়ে যান। পুরো রাত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই বাঙ্কারেই কাটিয়েছেন।

করোনার সংক্রমণে বিপর্যস্ত আমেরিকায় সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব চলছে। নগরী ও রাজ্যগুলো থেকে লকডাউন শিথিল করার সময়ে এমন বিক্ষোভ দ্রুতই উত্তাল হয়ে উঠেছে। টানা চার দিন থেকে চলা আন্দোলন মাসব্যাপী চলবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যমে ৩১ মে প্রকাশিত এ সংবাদে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিরাপত্তা কখনো হুমকির মুখে ছিল না। ৩০ মে সকালেই তিনি ফ্লোরিডার উদ্দেশে হোয়াইট হাউস ত্যাগ করেছেন। আগের তিন দিনে ওয়াশিংটন ডিসিতে সিক্রেট সার্ভিসের অন্তত ৬০ জন কর্মী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জনগণের বিক্ষোভ প্রশমনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখনো নির্বিকার। উল্টো লোকজন লুটপাট করছে উল্লেখ করে গ্রেপ্তার ও সহিংসতায় জড়িতদের দীর্ঘমেয়াদি কারাগারে পাঠানোর হুমকি দিচ্ছেন।

এদিকে মডেল ও টিভি ব্যক্তিত্ব ক্রিসি টেইজেন গ্রেপ্তার হওয়া আন্দোলনকারীদের জামিনে সহযোগিতার জন্য প্রথমে এক লাখ ডলারের অনুদান ঘোষণা করেন। তাঁর এ ব্যক্তিগত অনুদানের টুইট নিয়ে অনলাইনে সমালোচনা চলছে। আন্দোলনকারীদের চরমপন্থি ও লুটপাটকারী হিসেবে উল্লেখ করা সমালোচকদের বিদ্রূপের জবাবে ক্রিসি তাঁর ব্যক্তিগত অনুদানকে দ্বিগুণ করে বলেছেন, তিনি আন্দোলনকারীদের জামিনের জন্য দুই লাখ ডলার প্রদান করবেন।

আমেরিকার মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে জর্জ ফ্লয়েড নামের আফ্রিকান-আমেরিকান এক ব্যক্তিকে ২৫ মে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে নির্যতন করেন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চাওভিন। এতে সাবেক বাস্কেটবল খেলোয়াড় ফ্লয়েডের মৃত্যু হয়। এক প্রত্যক্ষদর্শীর ধারণ করা ১০ মিনিটের ভিডিও ফুটেজে চাওভিন ফেঁসে যান। সেখানে দেখা যায়, গলায় হাঁটু চেপে ধরায় ফ্লয়েড নিশ্বাস না নিতে পেরে কাতরাচ্ছেন এবং বারবার চাওভিনকে বলছেন, ‘আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না।’ ভিডিওটি ভাইরাল হলে চাওভিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। মিনেসোটা থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো আমেরিকায়। কৃষ্ণাঙ্গদের পাশাপাশি অনেক শ্বেতাঙ্গও এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। চাকরি হারিয়েছেন চাওভিন। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

টানা চার দিনের মতো ৩১ মে নিউইয়র্কে ব্রুকলিনের বার্কলি সেন্টার এলাকায়, ইউলিয়ামসবার্গ, ম্যানহাটনের ইস্ট ভিলেজ, টাইম স্কয়ার, ইউনিয়ন স্কয়ার, ব্রায়ান্ট পার্ক, কুইন্স ও ব্রঙ্কসে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।

বেশ কিছু এলাকায় পুলিশের সদস্যদের হাঁটু গেড়ে বসে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে দেখা যায়। কোথাও কোথাও বিক্ষোভ সমাবেশ সহিংস ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। নিউইয়র্কে ৩৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। নগরীর পুলিশ কমিশনার জানিয়েছেন, বিক্ষোভে ৩৩ জন পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছেন এবং পুলিশের ২৭টি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। পুলিশ কমিশনার ডারমট শিয়া বলেছেন, কোথাও কোথাও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সহিংস লোকজন ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে।

রাজ্য গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো বলেছেন, সহিংস আন্দোলন পুরো পরিস্থিতিকেই পাল্টে দেয়। সহিংসতার দায় পড়ে আন্দোলনকারীদের ওপর।

জানা গেছে, বিক্ষোভ চলাকালে নিউইয়র্ক নগরীর মেয়র বিল ডি ব্লাজিওর মেয়ে চিয়ারা ব্লাজিও (২৫) গ্রেপ্তার হয়েছেন। ৩০ মে রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাঁকে ম্যানহাটানের ব্রডওয়ে ও ১২ স্ট্রিটের মোড় থেকে ট্রাফিক বাধাগ্রস্ত করার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়। চিয়ারা পুলিশকে বাবার পরিচয় দেননি। বাসার ঠিকানা দেখে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। পরে আদালতে হাজির হওয়ার নোটিশ দিয়ে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

নিউইয়র্কের অদূরে ফিলাডেলফিয়া নগরী গত চার দিনে বিক্ষোভ সমাবেশের অন্যতম নগরী হয়ে উঠেছে। সাংবাদিক শেখ খোরশান ৩১ মে রাতে জানিয়েছেন, ফিলাডেলফিয়ায় শতাধিক দোকান ভাঙচুর হয়েছে। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে দুটি বাংলাদেশি দোকানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে একটি নুরুল আলম চৌধুরীর গ্রোসারি স্টোর, অন্যটি জাফর ভুঁইয়ার ডিসকাউন্ট স্টোর। পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল লাগায় বাদশাহ আলম নামের একজন বাংলাদেশি আহত হয়ে হাসপাতালে গেছেন। নগরীতে ১ জুন সকাল ছয়টা পর্যন্ত আবার কারফিউ জারি করা হয়েছে। নগরীতে এর মধ্যেই ৬০০ ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়েছে।

মিশিগান থেকে ফারজানা চৌধুরী জানিয়েছেন, ডেট্রয়েট পুলিশের প্রধান জেমস ক্রেইগ ও ডুগান ৩১ মে বলেছেন, শহরজুড়ে বিক্ষোভকারীদের একটা বিরাট অংশ জড়ো হয়েছেন। তাঁরা শহরের পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল করে ফেলেছেন। নিয়ন্ত্রণে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নেতারা জনগণকে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। ডুগান বলেন, এমন আহ্বান সত্ত্বেও তাঁরা সম্মান দেখাননি। কিন্তু আমাদের জনগণকে নিরাপত্তা দিতে হবে। ৩০ মে রাত ১০টার দিকে বিক্ষোভকারীরা ডেট্রয়েট পুলিশ সদর দপ্তরের দিকে যান। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট, এম ফায়ারওয়ার্কস ও পাথর নিক্ষেপ করেন। পুলিশের আটটি গাড়ি এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর বিক্ষোভকারীরা থার্ড স্ট্রিট ও বাগলেতে পুলিশের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। রাত সাড়ে ১০টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করেন। এরপর গ্রেপ্তার শুরু হয়।

জননিরাপত্তার জন্য কারফিউ জারি করেছেন ডেট্রয়েট শহরের মেয়র মাইক ডুগান। ৩১ মে সন্ধ্যা সাতটা থেকে ২ জুন সকাল পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকবে। ডুগান বলেন, ৩০ মে রাতে যে সহিংসতা হয়েছে, তা আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই কারফিউ জারি করা হয়েছে। এই আইন ভঙ্গ করলে ৯০ দিন জেল এবং ৫০০ ডলার জরিমানা হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আপনার এবং শহরের প্রত্যেকের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের অগ্রাধিকার।’

নিউইয়র্ক সময় ৩১ মে রাত ১২টা পর্যন্ত জানা গেছে, আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ দমনে ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচনের মাত্র পাঁচ মাস আগে এমন উত্তাল অবস্থা রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে, এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। একপক্ষ বলছেন, সহিংসতা ও লুটপাট সামনে এনে ট্রাম্প তাঁর রক্ষণশীল ভিত্তিকে আরও মজবুত করতে পারেন। অন্যরা মনে করেন, অর্থনৈতিক মন্দা আর বিক্ষোভ একসঙ্গে ট্রাম্পের জন্য রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

তবে যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেনাবাহনীকে প্রস্তত থাকতে বলেছেন। সহিংসতার জন্য কেন গ্রেপ্তার ও দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড হচ্ছে না, এ প্রশ্ন রেখে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৩১ মে সন্ধ্যায় টুইট করেছেন।

নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাজিও বর্ণবাদকে জিইয়ে রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দায়ী করেছেন। চলমান বিক্ষোভের কারণে করোনা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিউইয়র্কের বাফেলো কাউন্টিতেও কারফিউ জারি করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *