সর্বশেষঃ

পুষ্টিগুণে ভরা লেবু এক বিস্ময়কর সৃষ্টিঃ

লেবু বিশ্বব্যাপী পরিচিত একটি জনপ্রিয় ফল। ভারতের দক্ষিন পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে লেবুর উৎপস্থিল, লেবু মুখরোচক উপাদেয় বলবর্ধক, লেবুর রস আচার ও শরবৎ তৈরী করা হয়। লেবুর তেল খাদ্য এবং প্রসাধনীতে ব্যপক ব্যাবহৃত হয়। এটি ভিটামিনে ভরপুর যেমন ভিটামিন B₁,B₂,B₃,B₅,Fe, K, Zn, কার্বহাইড্রেট ভ্যাট, প্রোটিন, ভিটামিন সি, রিবোফ্লোবিন, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, মিনারেল, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ফসফরাস সমৃদ্ধ এতে কোন সম্পৃক্ত চর্বি ও কোলেস্টেরল নেই, খুব কম মাত্রার ক্যালোরী আছে, লেবুর প্রধান আকর্ষন ভিটামিন সি।

এই ভিটামিন সি একটি গুরুত্ব পূর্ন উপাদান যা আপনার শরীরকে সক্ষম রাখতে সাহায্য করে। লেবু খেলেই প্রায় ৮৮% ভিটামিন সি চাহিদা পুরন করা সম্ভব। প্রাকৃতিক প্রিজারভেটিভস সাইট্রিক এসিড শরীরকে বিভিন্ন রোগজীবানুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে গড়ে তোলে। পৃথিবীব্যাপী লেবুর কদর রয়েছে নানা রকম খাদ্য, শ্যাম্পু, সাবানসহ প্রসাধনী সামগ্রীতেও রয়েছে লেবুর কদর। লেবুর অনেক জাত রয়েছে যেমন কাগজী লেবু, এলাচি লেবু, শরবতি লেবু, জামির লেবু, বারি লেবু-১,২,৩।

আপনি যদি শ্লিম হতে চান তাহলে নিয়মিত লেবু খেতে হবে। সকালে খালিপেটে লেবু পানি সঙ্গে সামান্য লবন আপনার চর্বি কমিয়ে দেবে শরীরের ক্ষতিকর বিষাক্ত দ্রব্য বের করে আপনাকে আকর্ষনীয় করে তুলবে, লেবুর রসে উচ্চমাত্রার ভিটামিন সি মানুষের রোগপ্রতিরোধী সিষ্টেমকে শক্তিশালী করে তোলে।
তৃষ্ণা মেটাতে লেবুর শরবতের ‍তুলনা নেই। তবে ঘুম থেকে উঠেই কুসুম গরম পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে খাওয়ার অভ্যাস স্বাস্থ্যের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। এরপর ১৫ থেকে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন। তারপর সকালের নাস্তা খান। এর ফলে শরীর অধিক পরিমাণে পুষ্টি শোষণ করতে সক্ষম হবে। বিশ্বজুড়ে লেবু খুবই জনপ্রিয় এবং প্রতিটি দেশের রান্নাঘরে এটি একটি অপরিহার্য খাবার। লেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি ও ফাইবার। তাছাড়া এটি উদ্ভিজ্জ যৌগ, খনিজ এবং দেহের জন্য প্রয়োজনীয় তেলে সমৃদ্ধ।

পুষ্টিগুণঃ
১০০ গ্রাম কাগজি বা পাতিলেবু থেকে পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায় ভিটামিন ‘সি’ ৬৩ মিলিগ্রাম, যা আপেলের ৩২ গুণ ও আঙ্গুরের দ্বিগুণ, ক্যালসিয়াম ৯০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ‘এ’ ১৫ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন ‘বি’ ০.১৫ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ২০ মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৩ মিলিগ্রাম।

লেবুর রসের উপকারিতাঃ

১। ক্যান্সার প্রতিরোধ করেঃ

লেবুতে রয়েছে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের সমারোহ যা শরীরকে বিভিন্ন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। নিয়মিত লেবু খাদ্যতালিকায় রেখে আমারা ক্যান্সারের হাত থেতে রক্ষা পেতে পারি। লেবু অনেক ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। বিশেষ করে স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে এর জুড়ি মেলা ভার।

২। পাকস্থলিকে সুস্থ্য রাখেঃ

যারা পেটের গোলযোগে ভুগছেন তাদের জন্য লেবু আদর্শ টনিক। পেটের গোলযোগের মধ্যে ডায়রিয়া, বদহজম, কোষ্টকাঠিন্য, আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে দেয়, শুরুতে এক গ্লাস লেবু+লবন পানি আপনাকে এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দেবে। লেবুর সঙ্গে এক চা চামচ মধু হলে আরো ভাল।

৩। ফুসফুসের জন্য ভালঃ

লেবু ফুসফুসের যতœ নেয় এবং শরীর থেকে বিষাক্ত দ্রব্য বের করে দেয়, লেবু শরীরের চর্বি এবং লিপিডের মাত্রা কম রাখে ।

৪। ক্ষত সারায়ঃ

লেবুর উচ্চ ভিটামিন যা শরীরের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা বৃদ্ধি করে যে কোন ভাইরাস জনিত ইনফেকশন যেমন ঠান্ডা, সর্দি, জ্বর দমনে লেবু খুব কার্যকারী, মুত্রনালীর ক্ষত সারাতেও লেবুর গুরুত্ব রয়েছে।

৫। হাইপার টেনশন কমায়ঃ

যারা খাবারে যথেষ্ট পটাশিয়াম গ্রহণ করে না, তারা সহজেই নান রকম হৃদরোগে আক্রন্ত হয়ে পড়ে। লেবুর রসে যথেষ্ট পরিমান পটাশিয়াম রয়েছে যা হাইপার টেনশন কমাতে সাহয্য করে।

৬। ত্বকের যত্নে লেবুঃ

প্রাকৃতিক পরিস্কার হিসাবে লেবুর জুড়ী নেই, এটি ত্বকের লাবন্য ধরে রাখতে সাহায্য করে, মধুর সাথে লেবুর রস মিশিয়ে ব্যবহার করলে ত্বকের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পায়। এটি ত্বকের সংকোচন সৃষ্টিকারী পদার্থকে নিয়ন্ত্রন রাখে। চামড়ার অতিরিক্ত তেল অপসারণ করে। লেবুর রস প্রাকৃতিক অ্যানটি সেপটিক। ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমন দূর করে। ব্রণ সারিয়ে তোলে, ত্বকের রং উজ্জল করে। বয়সের বলিরেখা দূর করে।

৭। লেবু মুখের দুর্গন্ধ দুর করেঃ

মাড়ীর ব্যাথা, দাতের সমস্যা মুখের দুর্গন্ধ দুর করে, লেবুর পানি খাবার পর দাত ব্রাশ করার প্রয়োজন নেই।

৮। নখকে সুন্দর করেঃ

একটুকরা লেবু দিয়ে নখ পলিশ করলে নখ তার বিবর্নতা থেকে উজ্জল রং ফিরে পায়। লেবুর পানিতে পা, হাত, ডুবিয়ে রাখলেও একটি উপকার হয়।

৯। পিএইচ মাত্রা নিয়ন্ত্রন করেঃ
শুনলে অবাক হতে হয়, লেবু অম্লীয় হওয়া সত্বেও শরীরে প্রয়োজনে ক্ষারধর্মী আচরন করে। এটি শরীরে এসিডিটি তৈরী করে না। এটি শরীরের পিএইচ মাত্রাকে সঠিক অবস্থায় রাখে। লেবুর রস+লবন পানি পান করলে পিএইচ মাত্রা ঠিক থাকে। শরীরে হাইড্রোজেনের পরিমাণের উপর অনেকাংশে সুস্থতা নির্ভর করে। সর্বমোট পিএইচ বা পাওয়ার অফ হাইড্রোজেন স্কেল হল ১ থেকে ১৪। মানবদেহে ৭ মাত্রার পিএইচ থাকা স্বাভাবিক। এর থেকে কম বা বেশি হলে শরীরে রোগের বিস্তার হতে পারে। অ্যাসিডিক বা ক্ষারীয় ফল হলেও লেবু মানবদেহে পিএইচ’য়ের মাত্রা সমন্বয় করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে যারা বেশি মাংস, পনির বা অ্যালকোহল গ্রহণ করেন তাদের জন্য লেবু সবচেয়ে বেশি উপকারী।

১০। শক্তি বৃদ্ধি করেঃ
লেবুর রস পরিপাক নালীতে প্রবেশ করে শরীরে শক্তি বৃদ্ধি করে। এটি মানসিক চাপ কমাতে ও মেজাজ ফুরফুরা করতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

১১। কিডনির পাথর দূর করতেঃ
লেবুতে উপস্থিত লবণ বা সাইট্রিক অ্যাসিড কিডনিতে ‘ক্যালসিয়াম অক্সালেট’ নামক পাথর গঠনে বাধা দেয়। সবচেয়ে সাধারণ কিডনি পাথরগুলোর মধ্যে এটি একটি।

১২। লিভার পরিষ্কার রাখেঃ
লেবুতে বিদ্যমান সাইট্রিক অ্যাসিড কোলন, পিত্তথলি ও লিভার থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করতে সাহায্য করে।

১৩। ভাইরাসজনিত সংক্রমণ প্রতিরোধঃ
ভাইরাসজনিত সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে লেবুর রস।
১৪। হজমে সাহায্য করেঃ
লেবুর রস হজমে ব্যাপক সাহায্য করে। সেইসঙ্গে পরিপাক নালী থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়।এটি কোষ্ঠকাঠিন্যও দূর করে।

১৫। ত্বক পরিষ্কার করেঃ
লেবুতে উপস্থিত ভিটামিন ‘সি’ ত্বকের কোষের ক্ষয় প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয়, এই উপাদান শরীরে কোলাজেন তৈরি করে। যা মুখের অবাঞ্ছিত দাগ দূর করে ঔজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনে।

১৬। ওজন হ্রাসঃ
লেবুতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ রয়েছে। যা ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা খালি পেটে লেবুর রস খান, তাদের ওজন দ্রুত হ্রাস পায়। সুতরাং ওজন বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তা না করে প্রতিদিন সকালে লেবুর রস খান।

১৭। মূত্রনালীর সংক্রমণ দূরঃ
যদি মূ ত্রনালীতে সংক্রমণ ঘটে। তাহলে প্রচুর পরিমাণে লেবুর রস পান করুন। এটি আরোগ্য লাভে সাহায্য করবে।

১৮। চোখের স্বাস্থ্যঃ
লেবুর রস চোখের স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ করে এবং চোখের সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করে।

১৯। রক্তবাহী ধমনী ও শিরাগুলোকে পরিষ্কার করেঃ
লেবু পানি শরীরের রক্তবাহী ধমনী ও শিরাগুলোকে পরিষ্কার রাখে।

২০। নারী ও গর্ভের সন্তানের জন্য ভীষণ উপকারিঃ
গর্ভবতী নারীদের জন্য খুবই ভালো লেবু পানি। এটা শুধু নারীর শরীরই ভালো রাখে না। বরং গর্ভের শিশুর অনেক বেশী উপকার করে। লেবুর ভিটামিন সি ও পটাশিয়াম শিশুর হাড়, মস্তিষ্ক ও দেহের কোষ গঠনে সহায়তা করে। মাকেও গরভকালে রোগ বালাই থেকে দূরে থাকে।

২১। দাঁত ব্যথা কমাতেঃ
দাঁতের সমস্যা প্রতিরোধে সহায়তা করে। দাঁত ব্যথা কমায়।

২২। বুক জ্বলা পড়া দূর করে
যাদের এই সমস্যা আছে রোজ আধা কাপ পানির মাঝে ১ চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন।

সতর্কতাঃ

প্রতিদিন ১২০ মিলি লিটার পর্যন্ত লেবুর রস খেতে পারেন. অর্থাৎ প্রতিদিন ফলের রস এবং লেবু রস মিলিয়ে ১২০ মিলি লিটারের বেশি খাওয়া শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। তবে গর্ভবতী দের ক্ষেত্রে এবং যাদের দুগ্ধ জাতীয় খাবারে সমস্যা রয়েছে তাঁরা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া লেবুর রস বা খালি পেটে গরম জলে লেবু খাবেন না।

ড. উজ্জল কুমার নাথ
প্রফেসর
কালীতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ময়মনসিংহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *