সর্বশেষঃ

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেলে দেশ মরুকরণের দিকে যাবে’

দেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে আশঙ্কাজনক হারে। দখল-দূষণে নদী, খাল, বিল ধ্বংস করা ও পানির অপব্যবহার এর অন্যতম কারণ। জাতিসংঘের এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে শীর্ষে থাকা দেশের তালিকায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১০টি দেশ স্থান পেয়েছে। সেই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামলে কমবে সুপেয় পানির উৎস। কৃষি ও শিল্পখাত পড়বে সমস্যায়। আশঙ্কা আছে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের।

পানির প্রাকৃতিক উৎস সংরক্ষণসহ পরিবেশ রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল গ্লোবাল টাইম২৪.কম কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়া নিয়ে তার মতামত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুল হক মিঠু।

গ্লোবাল টাইম২৪.কমঃ ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় আমাদের কোন ধরনের সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। পানির স্তর দ্রুত নামার কারণ কী?

শরীফ জামিল: ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ায় প্রথম যে সংকট তৈরি হবে সেটা হলো আমরা শিগগির চরম পানি সংকটে পড়বো। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সুপেয় পানির সংকট শুরু হয়েছে। পানি কমে যাওয়ায় ভূগর্ভে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়। ভূগর্ভে থাকা টেকটনিক প্লেটের অসামঞ্জস্যতা তৈরি হলে ভূমি দেবে যাওয়া বা অবনমন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেলে নদী-নালা শুকিয়ে যাবে। দেশ পুরো মরুকরণের দিকে চলে যাবে। হারিয়ে যাবে অনেক প্রাণী। কোনো এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি না থাকা মানে সেই এলাকাটাই ধ্বংস হয়ে যাওয়া। অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ কমছে। এর সঙ্গে ভুল পরিকল্পনাও জড়িত। যে হারে পানি তুলছেন সে হারে যদি পানি রিচার্জ না হয় তাহলে শূন্যতা তৈরি হয়। শুষ্ক মৌসুমে আমরা ট্রান্সবাউন্ডারি পানি পাই না। যেহেতু শুকনো মৌসুমে বিভিন্ন বাঁধের মাধ্যমে পানি সরিয়ে ফেলা হয়, সেহেতু সেসময় পানিশূন্যতা তৈরি হয়। জনসংখ্যা বেশি, আবার কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা বেশি, সে কারণে ভূগর্ভস্থ পানির প্রচুর ব্যবহার হয়। পানির রিজার্ভার বলতে আমাদের নদী ও খাল-বিলকে বোঝাই। সেগুলো আমরা দখল, দূষণ করে ফেলেছি।

গ্লোবাল টাইম২৪.কমঃ তাহলে মূল কারণ কোনটাকে বলবেন?

শরীফ জামিল: আমাদের দেশে অপরিকল্পিত পানির ব্যবহার এবং জলাশয়গুলো দখল, ভরাট ও দূষিত করে ফেলা।

গ্লোবাল টাইম২৪.কমঃ এ সমস্যা সমাধানে সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কথা বলা হচ্ছে, বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?

শরীফ জামিল: সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কেন লাগবে যদি আমরা পানি দূষণ না করি। প্রকৃতি প্রদত্ত পানি দূষিত করে কেন আবার ট্রিটমেন্ট করে পান উপযোগী করবো? শিল্পায়নের নামে আমরা নোংরা শিল্পগুলো অ্যাডপ্ট (অন্যের কাছ থেকে গ্রহণ) করছি। এটাতে উপকারের চেয়ে ভবিষ্যতে অপকার হবে। আমি নদী, খাল দখল-দূষণ করবো না। তাহলে তো এই প্ল্যান্টের প্রয়োজন নেই।

গ্লোবাল টাইম২৪.কম: গ্রামাঞ্চলে ডিপ টিউবওয়েলের যথেচ্ছ ব্যবহার কমিয়ে সেখানে কী নদীর পানি ব্যবহার করা যেতে পারে?

শরীফ জামিল: উজান থেকে আমাদের অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা আদায় করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। পল্লি অঞ্চলের নদী, পুকুরে পানি থাকলে ডিপ টিউবওয়েলের ওপর নির্ভরতা কমবে।

গ্লোবাল টাইম২৪.কম: গ্রামে পুকুর কমে যাওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন?

শরীফ জামিল: গ্রামের অনেক পুকুরে এখন শীতকালে পানি থাকে না। সেই পুকুরে জলজ প্রাণীও থাকে না। তখন পুকুর প্রয়োজনীয়তা হারায়। নদী, শাখা নদী শুকিয়ে যাওয়ায় পুকুরে পানি থাকে না। আরেকটা বিষয় পৌরসভায় পুকুর ভরাট নিষিদ্ধ। সরকারের আইন আছে। তারপরও দেখা যায় প্রভাশালীরা পুকুর ভরাট করছে। পুকুর দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ করার একটা মানসিকতা তৈরি হয়েছে। এসব কারণে গ্রাম থেকে পুকুর হারিয়ে গেছে।

গ্লোবাল টাইম২৪.কম: রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং কি সমাধান হতে পারে? বাংলাদেশে এর ব্যবহার হচ্ছে কি?

শরীফ জামিল: কিছু জায়গায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হচ্ছে। আমাদের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায়ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান দেবে না।

গ্লোবাল টাইম২৪.কম: তাহলে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কী?

শরীফ জামিল: দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হচ্ছে আমাদের জলাশয়গুলো হারাতে না দেওয়া। নদী দখলমুক্ত করা। সীমানা পিলার, ওয়াকওয়ে নির্মাণের নামে নদীর স্বকীয়তা নষ্ট করা হচ্ছে, দখল-দূষণ হচ্ছে- এগুলো বন্ধ করতে হবে।

আমাদের বিল, হাওর পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। বাঁধ তৈরির কারণে সিল্টেশন (পলি জমা) হচ্ছে। পলি জমাট হয়ে এগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে এ ধরনের জলাশয়গুলোর ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আমরা বলছি নদীমাতৃক দেশ, নদী আমাদের মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু নদী ব্যবস্থাপনায় আমরা শুরু থেকেই ভুল করেছি। নদীর সঙ্গে মিলেমিশে আমাদের বসবাস করার কথা। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের বন্যার পরে আমরা নদীকে শাসন করতে গেছি। আমাদের ডেল্টা অনেক বেশি পলি নিয়ে আসে, এটা অন্যান্য ডেল্টার মতো নয়। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র পৃথিবীর অনেক ডেল্টার তুলনায় অনেক বেশি পলি নিয়ে আসে। আমরা ভুল করেছি, আমাদের উচিত ছিল প্রাকৃতিক সমাধানে যাওয়া। নদীকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এখনো আমরা ব্যবহার করছি, এখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

ধীরে ধীরে পুরোনো নদী ও খালের নেটওয়ার্কে আমাদের ফিরে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে ডেল্টা প্ল্যানে ২১০০ আমাদের সে ধরনের প্রকল্প নিতে হবে। পাশাপাশি নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। তা না হলে একটার পর আরেকটা বড় সমস্যা আসবে, আর তাৎক্ষণিক সমাধানে সবাই উঠে পড়ে লাগবে।

গ্লোবাল টাইম২৪.কম: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে?

শরীফ জামিল:গ্লোবাল টাইম২৪.কমকেও ধন্যবাদ।