সর্বশেষঃ

মেয়র স্যারের চাউল ছাড়া না খাইয়া মরতাম

নিজস্ব প্রতিবেদক

৩৫ বছর আগে ভোলার নবিপুর গ্রাম থেকে বরিশাল শহরে জীবিকার সন্ধানে এসেছিলেন নুর ইসলাম। এখন তার বয়স পঞ্চাশ। অর্থাৎ মাত্র ১৫ বছর বয়সে চামড়া প্রক্রিয়জাত করতে পারতেন তিনি। চামড়া ধুয়ে লবন মাখানো, রোদে শুকানো। উপযুক্ত হলে প্যাকেট করে ঢাকার গাড়িতে তুলে দেওয়াই ছিল তার কাজ। আর বরিশাল নগরীর ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ৩৫ বছর কাজের সময় কাটিয়েছেন পদ্মাবতী এলাকায়। সেখানে গড়ে ওঠা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ট্যানারী কারখানায় কাজ করে স্ত্রী ও ৩ মেয়ে নিয়ে সুখেই ছিলেন।

কিন্তু কয়েক বছর ধরে চামড়ার বাজারে অব্যাহত ধ্বস নেমে আসায় কষ্ট শুরু হয় সংসারে। অন্যকাজে দক্ষ হলে হয়তো পেশাটা বদলে ফেলতেন। সেই সুযোগ এখন আর নেই। তার উপর এলো মহামারি করোনা। শুরু হয়েছে নতুন সংকট। ৪ মাস ধরে বেতন বন্ধ। তার কারখানায় খুব একটা চামড়া না আসায় অফুরন্ত অবসর। ঘরেও সীমাহীন টানপোড়েন।

নুর ইসলাম বলেন, চামড়ার বাজার ভালো না। গরুর চামড়া প্রতি ফুট ১০০ থেকে ৫০ টাকা দেওয়াও কঠিন। ছাগলের চামড়া তো ফ্রি।

তিনি বলেন, ৫ সদস্যের সংসার আমার। দশহাজার টাকা বেতন পাইতাম। ৪ মাস বেতন বন্ধ। আগের ঈদে বোনাস পাইতাম। এবার পাইনাই। করোনা দ্যাশে আওনের পর আমাগো দশা করুন।

তিনি বলেন, যে অবস্থা শুরু হইছিল তাতে মনে করছি না খাইয়া মরণ লাগবে। তয় আল্লায় মিলাইয়্যা দিছে। মেয়র স্যার আমাগো কষ্টডা বুঝচ্ছে।

নুর ইসলাম বলেন, করোনার শুরু থেকে শুরু। এহনও শ্যাষ হয় নাই। সাদেক মিয়া ফি-মাসে ১০ কেজি কইরা দুই কিস্তিতে চাউল দেয়। আয়-ইনকাম বন্ধ; তেনার চাউল না পাইলে এক ওয়াক্তও ঘরে চুলা জ্বলতো না।

শুধু যে নুর ইসলাম তেমন নয়। বরিশাল নগরীর পদ্মাবতী রোডে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী ‘চামড়ার গদি’তে সাক‚ল্যে বর্তমানে কাজ করছেন দুইজন শ্রমকি। অপর শ্রমিক শাহীন জানালেন, তারও একই হাল। চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় যা বেতন পাচ্ছেন তা ঘর ভাড়ায় চলে যায়। পরিবারসহ খেতে হলে চুরি-ছিনতাই ছাড়া কোন গতি ছিল না। তিনিও পেয়েছেন সিটি মেয়রের ত্রাণ।

জানা গেছে, ঠিক এক বছর পূর্বে ঈদ-উল-আযহা এলে শ্রমিকের খোশগল্পে গমগম করতো পদ্মাবতী। কিন্তু করোনার প্রভাবে যখন একের পর এক চামড়ার গদি বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে তখন শ্রমিকদেরও কোন উপায়ন্ত থাকে না। নুর ইসলাম জানান, যখন সুদিন আছিল তহন কুরবানী আইলে দেড়শ’ মানুষ কামলা দিতাম। বৎসরের বাকি টাইম কম হইলেও কুঁড়িজন শ্রমিক থাকতো। এহন আছি দুইজন।

জানা গেছে, প্রতি ঈদ-উল-আযহায় শ্রমিকদের পুরো বছরের সংসার চালানোর খরচ হয়ে যেত। তখন একজন শ্রমিক দিনে তিনবেলা খাবার এবং ৫০০০ হাজার টাকা চুক্তিতে কাজ করতো। ১৫০ শ্রমিক কাজ করার পরও শ্রমিক চাহিদা থাকতো। আর বছরের বাকিমাসগুলো ২০ হাজার টাকা চুক্তিতে কাজ করতেন শ্রমকিরা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে চামড়ার বাজারে ধ্বস নেমে আসায় জৌলুস কমতে থাকে পদ্মাবতীতে। অনেকেই চামড়ার গদি/দোকান বিক্রি করে দিয়েছেন। ব্যবসা বদলে পোশাকের ব্যবসা শুরু করেছেন। এমনটাই জানালেন বরিশাল চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহিদুর রহমান শাহীন। তিনি বলেন, সিন্ডিকেটের কারনে চামড়ার বাজার ধ্বংস হয়ে গেছে। ব্যবসা বদলানো ছাড়া আমাদের আর কোন পথ খোলা নেই। ইতিমধ্যে অনেকেই তেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, আমাদের ব্যবসায়ী সমিতির মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৫৪। বর্তমানে অধিকাংশরা ব্যবসার ধরণ বদলে ফেলায় সমিতিতে সদস্য নেই বললেই চলে। গদি চলে মাত্র দুটি।

তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা ভয়াবহ সমস্যায় আছি। অনেকের চামড়ার টাকা আটকে আছে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে আসন্ন কোরবানিতে কোন চামড়া কিনবো না বলে অধিকাংশ ব্যবসায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শাহীন বলেন, চামড়ার টাকা দেওয়াতো দূরের কথা; চামড়ায় লবনের খরচাটাও আমাদের এখন লোকসান।##