সর্বশেষঃ

শিশুর জেদ কীভাবে সামলাবেন

মনিকা পারভীন প্রীতি
আমি যখন আশপাশে দেখি কারো সন্তান অনবরত কাঁদছে, চিৎকার করছে, জেদ করছে কোনকিছু পাবার জন্য বা করার জন্য, আর তার বাবা-মা তাকে থামাতে তা দিয়ে দিচ্ছে তখনই, আমার তখন শিশুটার ভবিষ্যৎ ভেবে খারাপ লাগে।

খারাপ লাগে সেই শিশুর পরিবারের সবার জন্য যারা না জেনেই তাদের প্রিয় সন্তানকে একটা জেদি রাগি চরিত্রের অধিকারী বানিয়ে ফেলছেন। ছোট থেকে সন্তানকে শেখান সেলফ কন্ট্রোলড কীভাবে হতে হয়। আশা করি সবার কাজে দেবে। শিশুর জেদকে প্রশ্রয় দেবেন না।

কেন হয় টেম্পার ট্যানট্রাম বা জেদ?

শিশুরা তাদের নিজস্ব হতাশা, ক্ষোভ বা চাহিদা প্রকাশ করে জেদ বা ট্যানট্রামের মাধ্যমে। আমরা বড়রা যেভাবে নিজেদের এসব অনুভূতিগুলোকে আত্মসংবরণ বা সেলফ কন্ট্রোল করতে পারি শিশুরা তা মোটেই পারে না। তার ফলে তাদের আচরণে বাহ্যিক হতাশার প্রকাশ এভাবেই ঘটে। তিন থেকে সাত বছরের মধ্যে টেম্পার ট্যানট্রাম সবচেয়ে বেশি আত্মপ্রকাশ পায়। এসময়ে যদি সঠিকভাবে শিশুদের চালিত করা না যায় তাহলে আগামী দিনে এদের ব্যবহারের মধ্যে অনেক নেগেটিভ কোয়ালিটি জন্ম নেয়, যা শিশু ও তার পরিবারের ক্ষেত্রে মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়।

বয়স অনুযায়ী জেদের নমুনা: বিভিন্ন ধরণের সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেছে বিভিন্ন বয়সে শিশুদের জেদের বহিঃপ্রকাশ বিভিন্নভাবে হয়। তার একটা ধারণা দিই।

জন্ম থেকে দু’বছর পর্যন্ত: এসময়ে শিশু নিজের জেদের বহিঃপ্রকাশ মোটামুটি কান্নার মধ্যেই সীমিত রাখে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় শিশুর খাওয়া, ঘুম পর্যাপ্ত না হলে এ ধরণের জেদ করে থাকে। টয়লেট সংক্রান্ত অস্বস্তিও এর আর একটা বড় কারণ। এছাড়া বিভিন্ন শারীরিক অসুবিধার সৃষ্টি হলেও কথায় না বলে কান্নাকাটির মাধ্যমে তারা তা প্রকাশ করার চেষ্টা করে।

দু’বছর থেকে চার বছর: এসময় শিশুর অন্যান্য অভিব্যক্তির সাথে সাথে শিশুর ইমোশনাল দিকটারও বিকাশ হয়। তার ফলে জেদের প্রকাশও বিভিন্ন রকমভাবে পাওয়া যায়। কোনো জিনিস চেয়ে ব্যর্থ হলে শিশু কখনো চিৎকার করে, মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি খায়, অনেক সময় মা-বাবাকে আঘাত করে বা নিজেদের আঘাত করে। কখনো লাথি মারা বা থুতু দেওয়া, জিনিপত্র ছুড়ে ফেলা, বই ছিঁড়ে ফেলা, কামড়ে দেওয়া এসব উপসর্গও দেখা যায় জেদের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।

চার থেকে সাত বছর: এসময় শিশু প্রি-স্কুলের বয়স পেরিয়ে জুনিয়ার গ্রুপে পড়ে। আগেকার জেদ যদি ঠিকঠাক সামলান না যায় তাহলে এ বয়সে শিশুরা স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের জেদের আত্মপ্রকাশ করে নিজেদের পছন্দমতো উপায়ে। মা বাবারা বা পরিবারের বাকি সদস্যরা অতিষ্ট হয়ে ওঠেন এদের বাড়াবাড়িতে। মা বাবার সাথে উচ্চস্বরে ঝগড়া করা, মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া, খাবার খেতে না চাওয়া এসব অভ্যাসও যুক্ত হয় এদের ব্যবহারে।

কীভাবে সামলাবেন জেদ বা টেম্পার ট্যানট্রাম?

শিশুর জেদ সামলানোর প্রাথমিক উপায় নিজেদের মনকে শান্ত রাখা। তার জন্য দরকার উপযুক্ত প্ল্যানিং। প্রথম থেকেই যদি ওদের জেদজনিত ব্যবহারে লাগাম দেওয়া যায়, শিশুদের চারিত্রিক কাঠামোর অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায় গোড়ার থেকেই।

১. নিজেকে স্থিতিশীল রাখুন, উত্তেজিত হবেন না: যখনই শিশুরা জেদ করা শুরু করবে মা-বাবা ও পরিবারের সবাইকে খুব শান্ত ও সংঘবদ্ধ থাকতে হবে। যদি বাড়ির লোকের মধ্যে মতের অমিল হয় তার জেদের কারণ নিয়ে, তবু কোনোভাবেই শিশুর সামনে তা প্রকাশ করা চলবে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বাড়ির গুরুজনেরা ওদের এ জেদের অভিব্যক্তি মেনে নিতে পারেন না এবং স্নেহবশত তাদের দাবি করা জিনিসটি তারা দিয়ে দেন। এটা একেবারেই ভুল পদক্ষেপ। শিশুরা খুব সহজেই পরিবারের মেরুকরণ বুঝতে পারে এবং সেই পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করে।

২. নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রাখুন: বাড়ির মধ্যে জেদের সূত্রপাত হলে শিশুকে কিছু খেলনা দিয়ে আলাদা করে বসিয়ে রাখুন। লক্ষ্য রাখবেন জায়গাটি যেন সুরক্ষিত থাকে, কারণ এসময় শিশুরা বিক্ষুব্ধ অবস্থায় থাকে। নিজেরা শান্ত ও গম্ভীর থাকুন। খুব প্রয়োজনভিত্তিক কথা ছাড়া কোনোভাবেই কোনো অতিরিক্ত কথা বলবেন না। মারধোর বা বকাবকি করাও একদম নয় এসময়ে। এসময়ে কোনোভাবেই শিশুর সাথে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবেন না। শিশুর ব্যবহারকে কোনোরকম গুরুত্ব দেবার চেষ্টাও করবেন না। অ্যাটেনশন না পেলে ওদের মধ্যে শান্ত হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। একে বলে ট্যানট্রাম সাবসাইডিং।

৩. ধীরে ধীরে ট্যানট্রাম বা জেদ যখন কমে আসে সেই সময়টা প্যারেন্টিং এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। সেই সময় শিশুকে স্নেহের সাথে বোঝাতে হবে সে যা ব্যবহার করছে তা পরিবারের কারোর কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। যদি সে আবার ওরকম ব্যবহার করে আবার তাকে বাড়ির সবার নির্লিপ্ত ব্যবহার পেতে হবে। তার নিজস্ব চাহিদা নিশ্চয় থাকতে পারে, কিন্তু তা প্রকাশ করতে হবে সংযতভাবে। এভাবে তার মধ্যে সেলফ কন্ট্রোল বোধ তৈরি হবে।

৪. বাড়ির বাইরে শিশুরা অনেকসময় জেদের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এখনকার শিশুদের গন্তব্যস্থল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় শপিংমল। সেখানে সার সার সুন্দর করে সাজানো খেলনাপাতির সামনে নিঃসন্দেহে তাদের চাহিদার পরিমান হয়ে যায় আকাশছোঁয়া। ফলে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি পাওয়ার জন্য ট্যানট্রাম শুরু করে তারা। এক্ষেত্রে দুটি সমাধান আছে। প্রথমত, শপিংমল জাতীয় জায়গায় শিশুদের যতটা কম নিয়ে যাওয়া যায় ততই ভালো। শিশুদের রিক্রিয়েশন খেলার মাঠ হতে পারে, কিন্তু শপিংমল নয়। যদি একান্তই নিয়ে যেতে হয় বাড়িতে তাকে বারবার কাউন্সেলিং করে নিয়ে যাওয়া উচিত।

এ বিষয়ে একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। ধরলাম শিশুর নাম নাইওমি। পাঁচ বছরের নাইওমি তার বাবার সাথে অ্যামিউজমেন্ট পার্কে যাবার প্ল্যান করেছে। তার বাবা তার জন্য কিছু শর্ত দিলেন। অ্যামিউজমেন্ট পার্কে গিয়ে তিনবারের বেশি কিছু আবদার করা চলবে, তার বেশি আবদার করলে তাকে পার্ক থেকে ফিরিয়ে আনা হবে। পার্কে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নাইওমির তিনটে আবদার পূরণ হয়ে গেল। এবার চতুর্থ আবদারের জেদ শুরু করা মাত্রই তার বাবা তাকে তাদের শর্তের কথা মনে করিয়ে দিলেন। তবুও সে যখন জেদ অব্যাহত রাখল, তার বাবা একটুও বকাবকি না করে বা উত্তেজিত না হয়ে তাকে নিয়ে তখনই পার্ক থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এল। বাবার এ আকস্মিক ব্যবহারে নাইওমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও বুঝতে পারল সে তার শর্ত রাখেনি বলেই তাকে এই ফলভোগ করতে হল। নাইওমি বাইরে বেড়াতে গিয়ে আর কখনো শর্তভঙ্গ করেনি।

৫. যেসব মায়েরা কর্মরত তাদের অনেকসময় একটা অকারণ অপরাধবোধ কাজ করে। তাদের সবসময়ই মনে হয় শিশুকে সে অযত্ন করছে। তাই কাজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় প্রায়ই শিশুদের জন্য চকোলেট, চিপস বা খেলনাপাতি নিয়ে বাড়িতে ঢোকেন। এতে স্বভাবতই শিশুর মনে চাহিদার মাত্রা বাড়ে। এ ধরণের ‘পেরেন্টিং ব্রাইবিং’ শিশুদের জেদ বা ট্যানট্রামের অন্যতম কারণ।

শিশুকে সহজভাবে বোঝান আপনার বাইরে কাজ করাটা প্রয়োজন। শিশুর এক্সপেক্টেশন ম্যানেজ করুন যতটা সম্ভব। দেখবেন ও অনেক সহজভাবে বড় হচ্ছে। বাড়ি ফিরতে দেরি হলে চকোলেট নিয়ে বাড়িতে আসার প্রয়োজন নেই, বরং ফিরতে ফিরতে ফোনে ওর সাথে প্ল্যান করে ঠিক করুন আজ রাতে কী গল্প বলবেন ওকে। দেখবেন জেদ উধাও হয়ে অনেক বেশি উৎসুকভাবে ও অপেক্ষা করছে আপনার।

৬. শিশুর মধ্যে জেদ সংবরণের প্রবণতা দেখলে প্রশংসা করুন। আপনার প্রশংসা আপনার শিশুকে উৎসাহিত করবে সেলফ কন্ট্রোল শেখাতে। শিশুর জেদ বা ট্যানট্রাম সামলানোর জন্য মারধোর বা বকাবকির প্রয়োজন হয় না। দরকার কেবল আপনার ধৈর্য বা পেশেন্স, উপযুক্ত প্ল্যানিং, বাড়ির সব সদস্যদের শিশুদের প্রতি একই ধরণের ব্যবহার আর পজিটিভ বা অথরিটেটিভ প্যারেন্টিং পদ্ধতি।

লেখক: প্যারেন্টস ট্রেইনিং টিচার, ‘মাদার স্কুল’ প্রজেক্ট, সিপিডি