সর্বশেষঃ

সূরা ফাতিহা

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

কুরআন মজিদের প্রথম সূরার নাম ফাতিহা। ফাতিহা শব্দের অর্থ হচ্ছে উপক্রমণিকা, প্রারম্ভিকা, ভূমিকা। এই সূরার বেশ কয়েকটি নাম রয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : উম্মুল কিতাব, উম্মুল-কুরআন, সূরাতুর রুকিয়া, আসাসুল কুরআন, ওয়াফিয়া, কাফিয়া, সূরাতুল কানয, সূরাতুল হাম্্দ, সূরাতুস সালাত, সূরা দু’আ, সাব্’আল মাছানি।

তবে সূরা ফাতিহা উম্মুল কুরআন, উম্মুল কিতাব, সাব’আল মাছানি নামে সমধিক পরিচিত। একে ফাতিহাতুল কিতাবও বলা হয়েছে। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সূরা ফাতিহাকে শ্রেষ্ঠতম সূরা বলেছেন। তিনি একে শ্রেষ্ঠতম অভিহিত করে বলেন : এই বার বার পঠিত সাতটি আয়াত (সাব’আ মাছানি) এবং মহান কুরআন (আল কুরআনুল আজীম) যা আমাকেই প্রদান করা হয়েছে। (বুখারী শরীফ, কিতাবুত্ তফসীর)।

সূরা ফাতিহায় সাতখানি আয়াতে কারিমা রয়েছে। এই সূরা প্রত্যেক সালাতের প্রত্যেক রাক’আতে অবশ্যই পাঠ করতে হয়। যে কারণে একে বার বার পঠিত সাত আয়াত বলা হয়। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : ওয়া লাকাদ আতায়নাকা সাব’আম্্ মিনাল মাছানি ওয়াল কুরআনাল আজীম- (হে রসূল) আর আমি তো আপনাকে দিয়েছি সাত আয়াত যা পুনঃপুনঃ আবৃত্ত হয় এবং দিয়েছি মহান কুরআন (সূরা হিজর : আয়াত ৮৭)।

সূরা ফাতিহাকে উম্মুল কুরআন বা উম্মুল কিতাব এই জন্য বলা হয় যে, এই সূরা দিয়েই কুরআন মজিদের উদ্বোধন হয়েছে এবং কুরআন মজিদের সমগ্র শিক্ষার সারকথা এতে রয়েছে। উম্মু-এর আভিধানিক অর্থ মা বা জননী।

উম্মুল কিতাবের উল্লেখ কুরআন মজিদে রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : হুওয়াল্লাযী আন্যালা ‘আলায়কাল কিতাবা মিন্্হু আয়াতুম্্ মুহকামাতুন হুন্না উম্মুল কিতাব- (হে রসূল) তিনিই (আল্লাহ্) আপনার প্রতি এই কিতাব নাযিল করেছেন যার কতক আয়াত মুহকাম (সুস্পষ্ট), এগুলোই উম্মুল কিতাব (কিতাবের মূল)। (সূরা আল-ইমরান : আয়াত ৭)।

সূরা ফাতিহা নাযিল হয় কুরআন নাযিলের সূচনাকালেই। প্রথমে নাযিল হয় সূরা আলাকের প্রথম পাঁচখানি আয়াতে কারিমা ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ রমাদান রাতে। এর তিন বছর পর সূরা মুদ্দাস্সির ও সূরা মুযাম্মিলের অংশবিশেষ নাযিল হয় এবং অধিকাংশের মতে এই সময়েই যে পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল হয় সেই সূরাখানিই হচ্ছে সূরা ফাতিহা। এই সূরার শুরুতেই আল্লাহর প্রশংসা, তাঁর পরিচয় তুলে ধরে ইরশাদ হয়েছে : আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল ’আলামীন- যাবতীয় প্রশংসা বিশ্বজগতের রব্ আল্লাহরই জন্য।

দ্বিতীয় আয়াতে কারিমায় ইরশাদ হয়েছে, আর রহমানির রাহীম- পরম করুণাময় দয়ালু দাতা। আল্লাহর এই দুইখানি গুণবাচক নাম এই সূরা ফাতিহাতেই সর্বপ্রথম ঘোষিত হয়।

কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে এই যুগল নাম বিধৃত হয়েছে। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম- এই প্রারম্ভিক উচ্চারণেও রহমান, রহীম দুই মুবারক নামকে যুক্ত অবস্থায় দেখতে পাই।

সূরা ফাতিহার তৃতীয় আয়াতে রয়েছে, মালিকি ইয়াওমিদ্দীন- রোজ হাশরের মালিক বা কর্মফল দিবসের মালিক। এর অর্থ প্রতিদান দিবসের মালিকও করা যায়। আল্লাহ্ হাশরের ময়দানে বিচার করবেন। পৃথিবীতে বিন্দু পরিমাণ ভাল কাজ করলে সেটাও দেখানো হবে, আর বিন্দু পরিমাণ মন্দ কর্ম করলে সেটাও দেখানো হবে এবং তারই নিরিখে বিচারে কেউ ভাল বলে বিবেচিত হলে সে জান্নাতে যাবে আর মন্দ লোক যাবে জাহান্নামে। আল্লাহ্ রহমানুর রহীম সেই রোজহাশরে নিখুঁত বিচার করবেন।

সূরা ফাতিহার চতুর্থ আয়াতে কারিমায় বান্দাকে আল্লাহর কাছে চাওয়ার বাক্যগুলো শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যা কানাসতা’ঈন- আমরা আপনারই ইবাদত করি এবং আপনারই সাহায্য প্রার্থনা করি। এই উচ্চারণের মধ্য দিয়ে বান্দা মূলত আল্লাহর নিকট সামগ্রিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। তখন তার মধ্যে নিজের অজান্তেই যেন অনুরণিত হয় : লাইলাহা ইল্লাল্লাহ্- আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই, লা মওজুদা ইল্লাল্লাহ্- আল্লাহ্ ছাড়া কোন অস্তিত্ব নেই, লা মকসুদা ইল্লাল্লাহ্- আল্লাহ ছাড়া কোন আকাক্সক্ষা নেই, লা মালিকা ইল্লাল্লাহ্- আল্লাহ্ ছাড়া কোন মালিক নেই। আমার সব চাওয়া-পাওয়া আল্লাহরই নিকট।

আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণের দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণার মধ্য দিয়ে আল্লাহর কাছে সহজ-সরল পথের দিশা লাভের জন্য আবেদন করার বাণী প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে সূরা ফাতিহার পঞ্চম ও ষষ্ঠ নম্বর আয়াতে কারিমা দু’খানিতে। ইরশাদ হয়েছে : ইহ্িদ নাস্সিরাতাল মুসতাকিম, সিরাতাল্লাযিনা আন্’আম্তা ‘আলায়হিম- আমাদেরকে সহজ-সরল পথ (সিরাতুল মুসতাকিম) দেখান, তাদের পথ যাদেরকে আপনি নি’আমত (অনুগ্রহ) দান করেছেন।

এখানে সিরাতুল মুসতাকিম কোনটি তা বলতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, সিরাতুল মুসতাকিম হচ্ছে সেই সিরাত বা পথ যে পথে চলে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করে যাঁরা ধন্য হয়েছেন, যাঁরা আল্লাহর প্রিয় ও মনোনীত বান্দা হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন, সেই পথ।

কুরআন মজিদের অন্য এক আয়াতে কারিমায় এই নি’আমত প্রাপ্ত কারা তাঁদের পরিচয় দিয়ে ইরশাদ হয়েছে : আল্লাযিনা আন’আমাল্লাহু আলায়হিম মিনাননাবিয়িনা ওয়াস্্ সিদ্দিকিনা ওয়াস শুহাদা ওয়াস সালিহীন- আল্লাহ যাঁদের প্রতি নি’আমত দান করেছেন তাঁরা হচ্ছেন : নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ এবং সালিহ অর্থাৎ সৎ কর্মপরায়ণগণ।

এখানে লক্ষণীয় যে, নবী-রসূলগণের পরে সিদ্দীক, তারপর শহীদ ও সালিহ বান্দাদের মর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে। এঁরাই হচ্ছেন সেই সব ওলি, গওস, কুতুব যাঁরা আল্লাহর বিধানকে (শরিয়াত) সমুন্নত করেছেন এবং তা নিজ নিজ জীবনে পুঙ্খানুপুঙ্খ পালন করে আল্লাহর মারিফাত হাসিলের জন্য তরিকত অনুযায়ী যিকর-আযকার, মুরাকাবা-মুশাহাদা করে হকিকতে উন্নীত হয়ে মারিফাত হাসিল করেছেন। এঁরাই হচ্ছেন- হাক্কানী পীর-মুর্শিদ। তাঁরা রুহানি কামালত নিজেরা কঠোর রিয়াযতের মাধ্যমে লাভ তো করেনই, তাঁদের কাছে মুরিদ হয়ে সবকাদি গ্রহণ করে অন্যরাও রিয়াযতের মাধ্যমে সেই ইনাম লাভ করতে পারেন।

সূরা ফাতিহার সপ্তম আয়াতে কারিমায় ভ্রান্ত পথ, শয়তান ও তাগুতের পথ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য আবেদন-নিবেদন ব্যক্ত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : গায়রিল মাগদুবি ‘আলায়হিম ওয়ালাদ্দল্লীন- তাদের পথ নয়, যাদের ওপর আপনার গজব নিপতিত হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট।

সূরা ফাতিহা পাঠ করার পর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আমিন বলতেন : যে কারণে এই সূরাখানি পড়ে আমিন বলতে হয়। আমিন অর্থ হচ্ছে কবুল কর। আমরা খ্রিস্টানদেরও প্রার্থনা শেষে আমিন বলতে দেখি।

সূরা ফাতিহার অসংখ্য মাহাত্ম্য রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : হযরত ইমাম জাফর সাদিক (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, ৪০ বার বিসমিল্লাহ্সহ সূরা ফাতিহা পাঠ করে পানিতে ফুক দিয়ে সে পানি জ্বরাক্রান্ত কিংবা কঠিন রোগাক্রান্ত রোগীর চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিলে আল্লাহর রহমতে রোগ নিরাময় হয়। যিনি এই ফুক দেবেন তাঁকে অবশ্যই শুদ্ধাচারী আমলদার কামিল ব্যক্তি হতে হবে।

এ ছাড়াও কঠিন দুরারোগ্য অসুখে সূরা ফাতিহায় শিফা রয়েছে। এই সূরা তিলাওয়াত করলে সমগ্র কুরআন মজিদের দুই-তৃতীয়াংশ সওয়াব পাওয়া যায়। এই সূরার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বান্দা কি পদ্ধতিতে চাইবে বা দু’আ করবে তা শিখিয়ে দেয়া হয়েছে।

সূরা ফাতিহা ছাড়া সালাত (নামাজ) হয় না- এরই মধ্য দিয়ে এই সূরার গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি করতে পারি। ইলমে তাসাওউফ অর্জন করতে পারলে এর মর্ম প্রত্যক্ষ দর্শনের মাধ্যমে আত্মস্থ করা সম্ভব হয়। সূরা ফাতিহার এক নাম রুকিয়া, আর এক নাম শিফা। প্রথমটির অর্থ ফুক দেয়া আর দ্বিতীয়টির অর্থ নিরাময় বা আরোগ্য। এই সূরাই আদতে আসাসুল কুরআন অর্থাৎ কুরআনের বুনিয়াদ বা ভিত্তি।

লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ