সর্বশেষঃ

৭ জুন : স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তরণের দিবস

মুজিব ভাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে এসে রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “মনু মিয়া আমার আলমের কাছে বলে গেছে, সে ছয় দফার জন্য রক্ত দিয়ে গেছে, বাংলার মুক্তির জন্য রক্ত দিয়ে গেছে। আমি এই জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে শপথ নিয়ে গেলাম- তার রক্তের সঙ্গে শেখ মুজিব কখনো বেইমানি করবে না। ”

৬৫-এর যুদ্ধে ভারতের কাছে চরম মূল্য দিয়ে আইয়ুব খানকে তাসখন্দ চুক্তির ভিত্তিতে রক্ষা পেতে হয়। এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে পিডিএম একটি সর্বদলীয় গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করে। মুজিব ভাই (তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) ওই বৈঠকে পূর্ব-পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষার আঙ্গিকে ছয় দফা প্রস্তাবটি পেশ করেন।

আহমদ ফজলুর রহমান, রুহুল কুদ্দুস, শামসুর রহমান খান (জনসন ভাই) ও রেহমান সোবহান ছয় দফা কর্মসূচিটি প্রণয়ন করে মুজিব ভাইয়ের হাতে তুলে দেন। গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানকারী সব দলই এটিকে আন্দোলন কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে অক্ষমতা প্রকাশ তো করলই, বরং তারস্বরে অপপ্রচার শুরু করলÑ শেখ মুজিব ছয় দফা কর্মসূচি প্রদান করে সর্ব-পাকিস্তানি আইয়ুব উৎখাতের আন্দোলনকে পিছিয়ে দিল। মুজিব ভাই (তখন তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ) পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে ছয় দফাকে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে অনুমোদন লাভের জন্য দলের বর্ধিত সভায় পেশ করেন। দুঃখজনক হলেও বাস্তব, ওই বর্ধিত সভায়ও সেটা অনুমোদিত হয়নি।

এ অবস্থায় ছাত্রলীগের তদানীন্তন সভাপতি সৈয়দ মাযহারুল হক বাকী ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাককে ডেকে তাদের হাতে ছয় দফার একটি খসড়া তুলে দিয়ে মুজিব ভাই বললেন, এটি মূলত জাতির মুক্তিসনদ। আমি ছাত্রলীগের হাতে এই মুক্তিসনদটি তুলে দিলাম। সে দিন অকুতোভয়ে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব এই কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব গ্রহণ না করলে ছয় দফা আঁতুরঘরেই মৃত্যুবরণ করত, আলোর মুখ আর দেখত না। ছাত্রলীগ নেতৃত্ব এই কর্মসূচিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টায় ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতে থাকে। ছয় দফা প্রদানের পরপরই মুজিব ভাই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ডাকেন। কাউন্সিলে ছয় দফা অনুমোদিত হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে মুজিব ভাই সভাপতি নির্বাচিত হন। তবুও ছয় দফাকে বাংলার মানুষের মননশীলতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়ার মূল শক্তি ও প্রতীতির জায়গা ছিল ছাত্রলীগ।

কিন্তু মুজিব ভাই বাংলাদেশের প্রতিটি মহকুমায় সফর করার সিদ্ধান্ত নেন; সেটিও সফল করার দায়িত্ব নেয় ছাত্রলীগ। কয়েকটি মহকুমা শহরে সভা করার পর জেলাভিত্তিক সভা করার পরই যশোরে তাকে গ্রেফতার করা হলো। জামিন পেলে আবার খুলনায় গ্রেফতার করা হলো, আবার মুক্তি পেলেন। এভাবে গ্রেফতার ও জামিনে আলো-আঁধারের খেলা চলতে চলতে সরকার সিদ্ধান্ত নিল, ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস-এ তাকে কারারুদ্ধ করার, যেখানে জামিনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মুজিব ভাই ও তার সহকর্মীসহ রাজবন্দীদের মুক্তি এবং ছয় দফাকে জাতীয় কর্মসূচিতে রূপদানের আঙ্গিকে ৭ জুন পূর্ব-পাকিস্তানব্যাপী পূর্ণদিবস হরতাল আহ্বান করা হয়

মূল নেতৃত্বের একটি অংশ ছয় দফাকে সমর্থন না করা এবং একটি অংশ কারাগারে থাকায় জনাব মিজানুর রহমান চৌধূরী ও আমেনা বেগম আওয়ামী লীগকে সংগঠন হিসেবে কোনো রকমে টিকিয়ে রেখেছিলেন। ইতিমধ্যে মানিক ভাইও ছয় দফার প্রতি তার সমর্থন ও প্রতীতি ঘোষণা করেন (এই সমর্থন আদায়ে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ও সৈয়দ মাযহারুল হক বাকী’র অদম্য প্রচেষ্টার সঙ্গে আমিও সম্পৃক্ত ছিলাম)। একদিকে ইত্তেফাক, অন্যদিকে ছাত্রলীগ (তখনো আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতৃত্বের মধ্যে ছয় দফার পক্ষে প্রতীতি ও প্রত্যয়ের জন্ম হয়নি) ৭ জুনের হরতালের পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান নেয়। ছাত্রলীগের প্রাক্তন নেতৃত্বের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খানসহ ছাত্রলীগের অসংখ্য সাবেক নেতৃত্ব ৭ জুন সফল করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে এসে অবস্থান নেন। তখন আমাদের সামনে ঘনঘোর অমানিশা। এনএসএফ থেকে শুরু করে ছাত্র ইউনিয়নসহ ডান-বাম সব সংগঠনই ছয় দফাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের ঘোরতর বিরোধী। আমরা যখন বাঙালির মননশীলতার আঙ্গিকে ছয় দফার মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর তখন ডানপন্থিরা তো বটেই, বামপন্থিরাও তারস্বরে চিৎকার করছেন, শেখ মুজিব দেশদ্রোহী, সিআইএর দালাল, ভারতের অনুচর। তার মৃত্যুদন্ডই তাদের প্রচারণার মুখ্য বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।
তখনো শ্রমিক লীগের জন্ম হয়নি। কিন্তু শ্রমিকদের এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে না পারলে ৭ জুন হরতাল পালন অসম্ভব ও অবাস্তব ছিল। সর্বজনাব খালেদ মোহাম্মদ আলী, কামরুজ্জামান টুকু, ফিরোজ নূন ও আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে তেজগাঁও এলাকাকে হরতালের পক্ষে সংগঠিত করার। তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র সংসদের সহসভাপতি রহমত উল্লাহ আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। আমাদের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ স্থানীয় প্রভাবশালী শ্রমিক নেতা রুহুল আমিন ভূইয়ার (তার বাড়ি নোয়াখালী) সমর্থন কিছুটা আদায় করতে সক্ষম হন। উনি পরোক্ষ সমর্থন দিলেও প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সঙ্গে কোনো মিটিং বা মিছিলে কখনো আসেননি।

৩ জুন তেজগাঁওয়ের একটি ময়দানে বিশাল(!) জনসমাবেশে কামরুজ্জামান টুকু সাহেব ও আমাকে পাঠানো হয় বক্তৃতা করার জন্য। যথাসময়ে পৌঁছে দেখলাম, সেখানে বিশাল তো দূরে থাক, জনাপাঁচেক লোকও উপস্থিত নেই। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, হঠাৎ একজন যুবক এসে পরিচয় দিলÑ “আমার নাম শহীদুল্লাহ, আমি তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ” আমার সমস্ত শরীর তখন রাগে, ক্ষোভে কাঁপছে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম চার/পাঁচ কেজি লজেন্স কিনতে হবে। পথশিশু-কিশোরদের যতটা সম্ভব জড়ো করে একটি খন্ড মিছিল করে হলেও ৭ জুন হরতালের বিষয়টি জানান দিতে হবে। প্রথমে ১৫/২০ জন ছেলে সমবেত হলো। তার মধ্যে একটি চটপটে ছেলেকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। সে লজেন্স বিলি করবে এবং যতটা সম্ভব পথপার্শ্ব এবং মহল্লার ছেলেদের মিছিলে সম্পৃক্ত করবে। আমি আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম তেজগাঁও স্টেশন এলাকায় যখন সভার জন্য দাঁড়ালাম ততক্ষণে প্রায় দুই আড়াই হাজার লোক সেই মিছিলে যুক্ত হয়ে গেছে। একটা হ্যান্ডমাইকও কোথা থেকে যেন জোগাড় হয়ে গেল। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আমি প্রবল উত্তেজনা নিয়ে বক্তৃতা করলাম। সে দিনের সেই সভায় আমি নিজে কেঁদেছিলাম, উপস্থিত জাগ্রত জনতাকেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছিলাম।

৬ জুন রাতে আমরা দায়িত্ব ভাগ করে দিয়ে তেজগাঁ’র শ্রমিকদের মেসগুলোতে গিয়ে অনুরোধ-উপরোধ করতে থাকলাম। ৩ তারিখ থেকে ৭ তারিখ সকাল পর্যন্ত প্রায় তিন-চারশ লোক প্রতিশ্রুতি দিলেন তারা সর্বাত্মক সহায়তা করবেন। আমরা তখন মনু মিয়াকে চিনতাম না। ৭ জুন ভোর থেকে শত চেষ্টা করেও একটা কার্যকর মিছিল বের করা সম্ভব হয়নি। যেটুকু হয়েছিল সেটাকে ঝটিকা মিছিল বলাই বাঞ্ছনীয়। প্রকাশ্যে মিছিল করতে ব্যর্থ হয়ে আমরা কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমরা ৭ জুন সকালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী এক্সপ্রেস ট্রেনটির গতিরোধ করে দেব। তখন আমার নিজের মধ্যে একটা নেশা ধরেছিল, যেকোনো উপায়ে একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই হবে। সংখ্যায় আমরা ২৫/৩০ জন হব। প্রচন্ড আবেগে আমরা রেললাইনের ওপর শুয়ে পড়ে রেলের গতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই আঙ্গিকে আমি অপেক্ষাকৃত একটু উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্য দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে উত্তেজক বক্তৃতা করছিলাম। সে খবর কোনোভাবে পুলিশের কাছে পৌঁছেছিল বিধায় তারা স্বতন্ত্র একটি ট্রেনের ইঞ্জিন নিয়ে ১০/১৫ জন পুলিশ পাইলটিং করে আগলে নিয়ে এগোচ্ছিল ওই এলাকাটি পার করে দেওয়ার জন্য। আমাদের কাছাকাছি এসে পুলিশভর্তি ইঞ্জিনটি থেকে একজন গুলি ছোড়ে (সেদিন নারায়ণগঞ্জ ও সদরঘাটেও গুলি হয়েছিল)। যে দুজনের ঘাড়ে ভর দিয়ে আমি বক্তৃতা করছিলাম তাদের একজন মাটিতে পড়ে গেলেন; তিনিই মনু মিয়া। তাকে সঙ্গে সঙ্গে তেজগাঁর একটি ক্লিনিকে নিয়ে গেলাম। তখনো তিনি জীবিত এবং জ্ঞান রয়েছে। বিন্দুমাত্র চিকিৎসা তার শুরু হয়নি, আমার কোলে মাথা রেখে মনু মিয়া বিড়বিড় করে বললেন, “মুজিব ভাই’র সঙ্গে দেখা হলে বলবেন, আমি ছয় দফার জন্য জীবন দিয়ে গেলাম। ” তেজগাঁও রেলগেটের কাছে পুলিশ আমাদের কাছ থেকে লাশ ছিনিয়ে নিয়ে গেল। ধস্তাধস্তিতে আমার শার্ট ছিঁড়ে গেছে, মনু মিয়া’র রক্তে আমার শরীর ভিজে গেছে। মনু মিয়া’র রক্তাক্ত গেঞ্জিটি আমি হাতছাড়া হতে দেইনি।

ওই গেঞ্জিটি একটি লাঠির মাথায় বেঁধে সেটিকে উড্ডীয়মান রেখে জঙ্গি মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগোতে থাকলাম। পুলিশ লাঠিচার্জ করলে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত, আবার মুহূর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়া লোকগুলো একত্রিত হয়ে উদ্বেলিত চিত্তে স্লোগান দিয়ে এগোতে থাকত। মনু মিয়ার মৃত্যুর পর আশ্চর্যজনকভাবে সমগ্র তেজগাঁও এলাকায় চরম উত্তেজনা ও মারাত্মক উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। পথের পাশের দোকানগুলো ঝটপট তাদের ঝাঁপ বন্ধ করতে থাকে। মিছিল কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে দোকান লুটপাটের আশঙ্কায় নয়, সেটি আমি নিশ্চিত। কারণ, আমি দেখেছি দোকান বন্ধ করে তারা সটকে পড়েনি, নীরবে নিভৃতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেনি। বরং অকুতোভয়ে দৃপ্ত পদে মিছিলে অংশ নিয়েছিল। গগণবিদারী কণ্ঠে স্লোগান দিয়ে সমগ্র মিছিলটিকে একটি অদ্ভুত উত্তেজনায় তারা মাতিয়ে তুলেছিল। সে দৃশ্য অবর্ণনীয়। আজকের প্রেক্ষাপটে অকল্পনীয়ও বটে। আজ পুলিশের গুলিতে অথবা হিংস্র পাশবিক কোনো সন্ত্রাসীর গুলিতে পিচঢালা পথে রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকলে মানুষ নির্বিকার চিত্তে হেঁটে চলে যায়। মিছিল করে বজ্রনির্ঘোষে গগণবিদারী স্লোগান দেওয়া তো দূরে থাক, কোনো রকমে আত্মরক্ষায় অথবা প্রাণ বাঁচাতে দ্রুত পদে তারা যে যার মতো সটকে পড়ে। এর পেছনের বাস্তবতাটি হলো, সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের যত উষ্মা-ক্ষোভই থাকুক না কেন, বিরোধী দলের প্রতি আস্থা ও প্রতীতি তাদের নেই। কারণ, আজকের প্রধান বিরোধী দলÑ তাদের শাসনামলের অত্যাচার-নির্যাতন, নিগ্রহ মানুষের স্মৃতিতে আজো ভাস্বর।

সে যাই হোক, পথিপার্শ্ব মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে মিছিলটির কলেবর বেশ বৃদ্ধি পায়। মিছিলটি যখন শাহবাগের মোড়ে, তখন দেখি, ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন তার সন্তান শাহীন রেজা নূরের হাত ধরে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে গর্বিত চিত্তে হাত নেড়ে মিছিলটিকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। এই দৃশ্যটি দেখে আমাদের- বিশেষ করে আমার উত্তেজনা এতই বৃদ্ধি পেল যে, শাহবাগ চত্বরের পাদপীঠে দাঁড়িয়ে আমি প্রচন্ড জ্বালাময়ী ভাষণ দিতে শুরু করলাম। ভাষণের ফাঁকে ফাঁকে স্লোগান দিচ্ছিলাম- ‘মনু মিয়ার রক্তে স্বাধীন হলো বাংলাদেশ’, ‘পিন্ডি না ঢাকা? ঢাকা ঢাকা’, ‘আইয়ুব না মুজিব? মুজিব মুজিব’। মিছিলটি নিয়ে যখন কার্জন হলে পৌঁছলাম, তখন দেখলাম, মনি ভাই, সিরাজ ভাই (সিরাজুল আলম খান), বাকী ভাই, রাজ্জাক ভাই, সাচ্চু ভাই, শহীদুল হক মুন্সী ভাই, আসমত আলী শিকদার ভাই, বাশার ভাইসহ ছাত্রলীগের অনেক বিদায়ী জ্যেষ্ঠ নেতা আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছেন। হয়তো তারা ইতিমধ্যেই আমাদের মিছিল সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন। মনু মিয়ার রক্তভেজা গেঞ্জি নিয়ে সেই মিছিলটি শুধু রাতারাতি আমাকে ভিন্নমাত্রায় উপস্থাপিত করেনি, ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের ঐতিহাসিক কর্মকান্ডে সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রেক্ষাপটে এই জীবনসায়াহ্নে এসে আজো আমি পুলকিত বোধ করি। গর্ব, আনন্দ আজো আমার সমগ্র সত্তাকে প্রচন্ড ভাবে নাড়া দেয়। আমাদের জ্যেষ্ঠ নেতারা তো বটেই, জেলখানা থেকে চিরকুট পাঠিয়ে মুজিব ভাইও অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ৭ জুনের কয়েকদিন পর আমি ডিপিআর আইনে গ্রেফতার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গেলে সৌভাগ্যক্রমে মুজিব ভাইয়ের পাশের সেলেই আমাকে রাখা হয়। প্রথম সুযোগেই মৃত্যুপথযাত্রী মনু মিয়ার কথাগুলো মুজিব ভাইকে আমি গভীর আবেগতাড়িত হৃদয়ে বর্ণনা করেছিলাম। তারই বহিঃপ্রকাশ মুজিব ভাই করেছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। মঞ্চে বসা অবস্থায় আমি আবার ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, মুজিব ভাই এক সন্ধ্যায় তার খাটে অর্ধশায়িত। ভাবী মোড়ায় বসে পান বানাচ্ছেন। আরেকটি মোড়ায় বঙ্গবন্ধুর শিয়রের কাছে আমি বসা। বঙ্গবন্ধু তার অতীত জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ এবং আবেগতাড়িত কিছু একটা বলছিলেন। হঠাৎ ভাবী আমাকে অপ্রস্তুত করার জন্যই বোধহয় বললেনÑভাই মনু মিয়ার মা তো একজন লেখাপড়া না জানা অতি সাধারণ মহিলা। মঞ্চে দাঁড়িয়ে আপনি মনু মিয়ার মাকে উদ্ধৃত করে অশ্রুসিক্ত নয়নে যে বয়ান করেন, ওই পল্টন ময়দানে দর্শকদের মধ্যে তো মনু মিয়ার মা-ও থাকতে পারেন। বলা তো যায় না, যদি কখনো উনি দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেন, না আমি তো কখনো আপনাকে মনু সম্পর্কে এত কথা বলিনি! আপনি কারাগারে যাওয়ার আগেও বলিনি, কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পরে তো বলিই-নি। আপনি কোথা থেকে এত কথা পেলেন? আমি বিন্দুমাত্র হতচকিত না হয়ে অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে তার জবাবে বলেছিলাম- ভাবী, আমি এ ধরনের অবস্থার মুখোমুখি কখনোই হব না। তার কারণ, পল্টন ময়দানে আমার বক্তৃতায় মনু মিয়া সম্পর্কে আমি যা বলি তার কোনোটাই বিন্দুমাত্র মিথ্যা নয়। মনু মিয়া মারা গেছে এটি সত্য। আমার বাঁ-পাশেই সে দাঁড়ানো ছিল সেটাও সত্য। শুধু মরণের বুলেটটা আমার বক্ষ বিদীর্ণ না করে নির্মম আঘাতে মনু মিয়াকে হত্যা করেছে। সত্যি মনু মিয়া কোনো দিন তার মাকে আর মা বলে ডাকতে পারবে না। এই নিরেট সত্যটাকে বুকে লালন করে আমি পল্টনের জাগ্রত উদ্গত, উদ্যত, উদ্ধত কালজয়ী জনতাকে উদ্দেশ করে বক্তৃতা করার সময় মনু মিয়ার মৃত্যুর ঘটনাটিকে আমার অনুভূতিপ্রবণ হৃদয়ের সবটুকু আবির মাখিয়ে আমার উদ্দীপ্ত হৃদয়ের স্পর্শ দিয়ে যখন তুলে ধরতাম, তখন স্মৃতির বেদনায় আমি কাঁদতাম, জনস্রোতকেও কাঁদাতাম। আমি আমার ভাষায় মনু মিয়ার মৃত্যুর ঘটনা, মৃত্যুর পরপরই তার মায়ের সঙ্গে দেখা করার ঘটনা, প্রায় তিন বছর পর কারাগার থেকে অবমুক্ত হয়ে আবার তার মায়ের কাছে যাওয়ার ঘটনাÑএ সব বাস্তবতাকে যখন তুলে ধরতাম, তাতে মিথ্যার কোনো প্রলেপ থাকত না। শুধু সত্যের সঙ্গে আমার আবেগ-উচ্ছ্বাস এবং উদ্বেলিত হৃদয়ের আবির মাখানো থাকত। আমি সেদিন মানুষকে শুধু কাঁদাইনি, কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও আমাকে প্রভাবিত করেনি। আবেগ আমাকে এতটাই তাড়িত করত যে, আমি পাগলপ্রায় হয়ে যেতাম। আমার সব সত্তা, চিন্তা-চেতনা, চাওয়া-পাওয়া- সবকিছু মনু মিয়ার বিদেহী আত্মার সঙ্গে আমার অজান্তেই মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। আমি বক্তৃতা করতাম না, উন্মাদের মতো আমার হৃদয়ের অনুভূতিকে তুলে ধরতাম। মনু মিয়ার মা আমাকে মাতৃস্নেহে জড়িয়ে ধরে যা বলত, সেটি সত্যিই তার নিজস্ব অভিব্যক্তি। সেটিকেই আমার অনুভূতির রং চড়িয়ে আমার হৃদয়ের তুলি দিয়ে মনু মিয়ার মায়ের অশ্রুর অভিব্যক্তির ছবি আঁকতাম। এটি আমার হৃদয়-নিংড়ানো নিরেট সত্য। এখানে আমার ভাষা, আমার প্রকাশভঙ্গি সন্দেহাতীতভাবে মনু মিয়ার মায়ের অভিব্যক্তি থেকে ভিন্নতর ছিল কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল না।

পুলিশের ছোড়া যে বুলেটটি মনু মিয়ার বক্ষ বিদীর্ণ করেছে, সেই বুলেটটি আমার বুকেও বিঁধতে পারত। মনু মিয়ার মতো আমিও শহীদ হতে পারতাম। আমি শহীদ হলে অন্য কেউ নিজের হৃদয়ের আবির মাখিয়ে অথবা চোখের জলে বুক ভাসিয়ে পল্টনের লাখ লাখ লোকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমার মতো করে বর্ণনা করত কিনা জানি না, মনু মিয়ার পরিবর্তে আমি শহীদ হলে আমার লাশ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে ওইরূপ ধস্তাধস্তি করত কিনা তাও জানি না- যেরূপ আমরা করেছিলাম। এখানে এই নিবন্ধে আমি একটি সত্যকেই তুলে ধরতে চাই; ঘটনাপ্রবাহ একটি, সেটিকে কে কীভাবে উপস্থাপন করবেন তা তার নিজস্ব মনন, নিজস্ব মানসিকতা, ভাষা ও আবেগের ওপর নির্ভর করে। এত বিস্তারিত না বললেও মূল ও সারকথা বললে মুজিব ভাই তো বটেই, সেই সন্ধ্যায় ভাবীর চোখও ছলছল করে ওঠে। মুজিব ভাই আবেগাপ্লুত হয়ে বলে ওঠেন- ‘ব্র্যাভো বয়। বাপকা বেটা সিপাইকা ঘোড়া, কিছু না মিলে তো মিলে থোড়া থোড়া। ’

পল্টনের লাখ লাখ মানুষ তখন আমার সামনে ছিল না কিন্তু তাদের বিশাল উপস্থিতি ছিল আমার হৃদয়ের ক্যানভাসে। পাকিস্তানের যে কোনো শোষণ-বঞ্চনার বিস্তীর্ণ ঘটনার বর্ণনা দিতে গেলে আমি পাগলপ্রায় হয়ে যেতাম। এখন জীবনসায়াহ্নে এসে আবেগ অনেকটাই স্তিমিত, তবু সে দিনের সেই রক্তস্নাত স্মৃতিগুলো আজো আমার হৃদয়কে আপ্লুত করে বলেই পরবর্তীতে পদ ও পদবির কিছুই না পাওয়া সত্ত্বেও আমি আমার হৃদয়ের গভীরে পরিতৃপ্ত ও আত্মহারা।

স্বায়ত্তশাসনের ছলে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। তবুও আজকের ৭ জুন গণতন্ত্রের প্রশ্নে মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত। ৬৬-এর ৭ জুনে পূর্ব পাকিস্তান ছিল গণতন্ত্রের জন্য উদ্যত উদ্ধত সংগ্রামরত একটি জলন্ত আবাসভূমি। আজকের ৭ জুনে সেই বাংলাদেশ নীরব, নিথর, নিস্তব্ধ প্রতিবাদহীন এক জনপদ।

লেখক :নূরে আলম সিদ্দিকী
স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *