সর্বশেষঃ

COVID-19: বিজ্ঞানের চোখে মাস্কের মুখোশ উম্মোচন

বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি ফেস মাস্ক ব্যবহার না করলে জরিমানার বিধান সম্বলিত একটি আইন পাশ করেছে। বিষয়টি অতিরঞ্জিত মনে হলেও এই করোনার সময় ভাইরাসের বিস্তার রোধে একটি মাস্ক ব্যবহার করা প্রত্যেক সচেতন মানুষের একান্ত প্রয়োজন। এশিয়ান দেশগুলো করোনা যুদ্ধে তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হবার একটি মূলকারণ হচ্ছে জনগণকে মাস্ক পড়তে উৎসাহিত করা।

মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কিছু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে।

একজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির নিঃশ্বাস, হাঁচি, কাশি অথবা কথা বলার সময় নিঃসৃত ভাইরাস বহনকারী বড় আকারের ছিটা বা ড্রপলেট (>৫ থেকে ১০ মাইক্রোমিটার) এবং ছোট আকারের ছিটা বা এরোসল (<৫ মাইক্রোমিটার) থেকে সুস্থ মানুষের দেহে করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে। যেখানে শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে আক্রমণকৃত অন্যান্য ভাইরাসের প্রতিরোধ ব্যবস্থা মূলত বড় ড্রপলেটকে কেন্দ্র করে নেয়া হয়, সেখানে করোনা ভাইরাস ক্ষুদ্রকণা এরোসলের মাধ্যমেও দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারে। এখন একজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি যার কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় নি, তার হাঁচি বা কাশি না থাকলেও তার নিঃশ্বাস বা কথা বলার সময় নিঃসৃত এরোসল একজন সুস্থ মানুষের দেহে আক্রান্ত করে তার মৃত্যুর কারণও হতে পারে। এখন এই ভাইরাস বহনকারী এরোসল থাকতে পারে আপনার অফিস কক্ষে, কর্মস্থলে, বাসে, ট্রেনে, লঞ্চ ঘাটে অথবা ঘরের বাহিরে যেকোনো জায়গায়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. উইলিয়াম রিস্টানপার্ট এর তত্ত্বাবধানে চীনের উহান শহরে করা একটি গবেষণায় দেখা যায়, লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়া করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির নিঃসৃত এরোসল শতকরা ৭৯ ভাগ ক্ষেত্রে করোনা ছড়ানোর জন্য দায়ী। তাই WHO (World Health Organization) থেকে শুরু করে CDC (Centers for Disease Control and Prevention) এবং NIH (National Institutes of Health) এর বিজ্ঞানীরা সবাইকে করোনা রোধে ফেস মাস্ক ব্যবহার করতে পরামর্শ দিয়েছেন। এখানে আরেকটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, করোনা বিস্তারের শুরুর দিকে CDC সবাইকে ৬ ফুট সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে উপদেশ দিয়েছিলো। তখন ধারণা করা হয়েছিলো যে, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির সাথে বের হওয়া বড় ড্রপলেট সর্বোচ্চ ৬ ফুট যেতে পারে এবং ওই ড্রপলেট ৫ সেকেন্ড এর মধ্যেই মাটিতে পরে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্সহপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এরোসলের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর বিষয়টি পরিষ্কার করেন। তারা তত্ত্ব দেন যে, করোনা রোধে ৬ ফুট সামাজিক দূরত্ব অনেকটা কার্যকর হলেও তা এরোসলের মাধ্যমে ভাইরাস আক্রমণ রোধে তেমন কার্যকরী নয়। কারণ বাতাসের মাধ্যমে এই এরোসল ক্ষেত্র বিশেষে ২০ ফুট পর্যন্ত যেতে পারে এবং একজন মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। সুতরাং, একটি যথাযথ ফেস মাস্ক ব্যবহার করা অতীব জরুরি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে ফেস মাস্ক করোনা রোধে সাহায্য করছে? করোনা ভাইরাস ACE-2 receptor এর নামে দেহকোষে অবস্থিত একধরণের প্রোটিনের সাহায্যে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. রাল্ফ বেরিকের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী প্রমাণ করেন যে, মানুষের শ্বাসনালীর উপরের অংশ অর্থাৎ নাকের কোষে ACE-2 receptor এর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। নাক থেকে শ্বাসনালীর যত নিচের দিকে যাওয়া যায় ACE-2 receptor এর পরিমাণ ততই কমতে থাকে এবং সেই হিসেবে ফুসফুসের গভীরে ACE-2 receptor এর পরিমাণ অনেক কম। ড. রাল্ফ বেরিকের গ্রুপ ধারণা করেন যে, করোনা ভাইরাস মূলত নাকের কোষে নোঙর করে নিঃশ্বাসের সাথে শ্বাসতন্ত্রের নিন্মাংশ অর্থাৎ ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ে। ড. রাল্ফ বেরিকের গবেষণা সংক্রান্ত সেই রিপোর্ট গত মে মাসের ২০ তারিখ বিশ্ববিখ্যাত Cell জার্নালে প্রকাশিত হয়। সুতরাং, ফেস মাস্ক নিঃশ্বাসের সাথে শরীরে করোনা ভাইরাস প্রবেশ রোধে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। মাস্ক কিভাবে পড়তে হবে? যদিও এটি খুবই সাধারণ প্রশ্ন তবুও সংবাদ মাধ্যমে প্রায়ই দেখা যায় কারো মাস্ক পকেটে, কারো হাতে, কারো থুতনির নিচে আবার কারো তা কপালে। মনে রাখতে হবে, মাস্ক এমন ভাবে পড়তে হবে যাতে তা নাকের ছিদ্র সম্পূর্ণভাবে ঢেকে থুতনির তলদেশ বিস্তৃত থাকে। সবসময় ধরে নিতে হবে যে, মাস্কের বাহিরের দিকে ভাইরাস লেগে আছে, তাই মাস্ক পরা বা খোলার সময় কখনোই বাহিরের দিকে হাত লাগানো যাবে না। সারা পৃথিবীর সমস্ত বিজ্ঞানীরা করোনা প্রতিরোধে ফেস মাস্কের ব্যবহারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লোকডাউন উঠে যাচ্ছে। উন্নত দেশে বিভিন্ন ধাপে লোকডাউন ওঠানোর পর সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা সম্ভব হয়/হচ্ছে। বাংলাদেশে অফিস, মার্কেট অথবা যানবাহন চলাচল সামান্য মাত্রায় খুললেও সর্বস্তরের জন সাধারণের মাঝে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার মতো সচেতনতা তৈরী হয় নি। এমতাবস্থায়, বাহিরে বের হতে গেলে যথাযথভাবে একটি মাস্ক ব্যবহার করোনা প্রতিরোধে অনেকাংশে সাহায্য করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *