সর্বশেষঃ

পানি বা সিঙ্গারা ফলকে অবহেলা করবেন নাঃ

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অতি পরিচিত একটি ফল হলো পানিফল। শুধু গ্রামে নয়, শহরের বাজারে বা ফুটপাতের ফল ব্যবসায়ীদের কাছেও দেখা মেলে এই ফলের। পানিতে জন্মে তাই বলা হয় পানিফল। বাংলাদেশের অপ্রচলিত ফলের মধ্যে একটি ফল হলো পানিফল।প্রাচীনকাল থেকে চীনে এ ফল চাষ হয়ে আসছে।আমাদের দেশেও পানিফলের চাষ শুরু হয়েছে। দেখতে অনেকটা সিঙ্গাড়ার মতো বলে লোকরা একে ডাকে সিঙ্গাড়াফল নামে।এটি একটি বর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ।

পানিফলের বৈজ্ঞানিক নাম Trapa natans। এর ইংরেজি নাম water chestnut। পানিফল স্থানভেদে water caltrop, buffalo nut, devil pod নামেও পরিচিত। পানিফলের আদি নিবাস ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা হলেও এর প্রথম দেখা পাওয়া যায় উত্তর আমেরিকায়। অথচ যুক্তরাষ্ট্রেরই বেশ কিছু জায়গায় পানিফলের গাছকে আগাছা হিসেবে গণ্য করা হয়! জানা যায় যে প্রায় ৩০০০ বছর পূর্বে চীনে পানিফলের চাষ হতো।

চীন, জাপান, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, ফিলিপাইন, আফ্রিকা এসব দেশে পানিফল আবাদ হয়।পানিফল কাঁচা,সেদ্ধ ও রান্না করে খাওয়া যায়।চীনে বিভিন্ন সবজির সাথে মিশিয়ে সবজি রান্না করা হয়।বিভিন্ন দেশে পানিফল দিয়ে তারা পিঠা কেক বিস্কুট তৈরি করে খায়, বাজারে বিক্রি করে।ঢাকার ফুটপাতের ভ্রাম্যমান ফলের দোকান প্রায়শ দেখা যায়।তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এ ফর সম্পর্কে অজ্ঞ।ভাদ্র মাস থেকে গাছে ফল আসা শুরু করে এবং পরিপক্ব হয়ে আশ্বিন-কার্তিক মাসে ফল বিক্রি শুরু হয়।ফলের রঙ লাল, নীলাভ সবুজ বা কালচে সবুজ। পুরু নরম খোসা ছাড়ালেই পাওয়া যায় হৃৎপিণ্ডকার বা ত্রিভূজাকৃতির নারম সাদা শাঁস। কাঁচা ফলের নরম শাঁস খেতে বেশ মজা। রসাল ও মিষ্টি মিষ্টি ভাব। গাছের শিকড় থাকে প্যাক বা কাদার মধ্যে, কা- থাকে জলে ডুবে, পাতা ফুল ও ফল ভাসে পানির উপরে।

পানিফলের পুষ্টিগুণঃ

এ ফলে আছে আঁশ, রাইবোফ্লেবিন, ভিটামিন বি, পটাসিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, আমিষ, ভিটামিন আছে। খাদ্য শক্তি আছে ৬৫ কিলোক্যালরি, জলীয় অংশ ৮৪.৯ গ্রাম, খনিজ পদার্থ ০.৯ গ্রাম, খাদ্য আঁশ ১.৬ গ্রাম, আমিষ ২.৫ গ্রাম, চর্বি ০.৯ গ্রাম, শর্করা ১১.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১০ মিলিগ্রাম, আয়রন ০.৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি১ ০.১৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২ ০.০৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ১৫ মিলিগ্রাম।

পানি ফলের উপকারিতাঃ

১। শীতল কারকঃ

পানি ফল শরীর শীতলকারক হিসেবে কাজ করে। এটি পানি পিপাসা রোধ করে এবং লালার পরিমাণ বৃদ্ধি করে। ডায়রিয়া ও হিট স্ট্রোক থেকে রক্ষা করতে পারে। গরম এবং শুষ্ক আবহাওয়ায় শরীরের সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখার জন্য সিঙ্গারা ফল খাওয়া উচিত।

২। জন্ডিস প্রতিরোধকঃ

জন্ডিস আক্রান্তদের জন্য পানি ফল খুবই উপকারী। এই ফল শরীরের বিষাক্ত পদার্থকে নির্মূল করে বলে জন্ডিসের উপশম করে।

৩। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুণসম্পন্নঃ

পানি ফল পলিফেনোলিক ও ফ্লেভোনয়েড অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের ভাল উৎস। ফলে এটি ক্যান্সার প্রতিরোধক, ভাইরাস জনিত রোগ প্রতিরোধক এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। প্লীহা ও পাকস্থলীকে শক্তিশালী করতেও সহায়তা করে।

৪। মূত্রতন্ত্রের প্রদাহঃ

মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ মোকাবেলায় পানি ফল ব্যবহার করা যায়। সিঙ্গারা ফলে থাকা এনজাইম মূত্রথলি পরিষ্কার করে এবং জীবাণু প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।

৫। বদহজম এবং বমি বমি ভাবঃ

বদহজম এবং বমি বমি ভাব হলে পানি ফল খাওয়া খুবই উপকারী। পানি ফলকে পাউডার বানিয়ে চা অথবা পানির সাথে মিশিয়ে খেলে কাশি ভাল হয়।

৬। উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধকঃ

যাদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের জন্য পানি ফল খুবই উপকারী। প্রাচীনকালে বাচ্চা প্রসবের পর রক্তপাত বন্ধ করার পানি ফল খেতে দেওয়া হতো। কেটে গেলে বা ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাত শুরু হলে অতিরিক্ত রক্তপাত বন্ধের জন্য এই ফল খাওয়া যায়। এ কারণে অস্ত্রোপচারের পর রোগীকে পানি ফল খাওয়া উচিত।

৭। চুলের যত্নেঃ

চুলের যত্নে এই ফলের আশ্চর্যজনক গুণ রয়েছে। এতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ই ও পটাশিয়াম রয়েছে যা চুলের যত্নে খুবেই কার্যকর।

৮। অন্যান্য ব্যবহারঃ

পানি ফলে ভিটামিন বি-৬ ও নিউরোট্রান্সমিটার রয়েছে। যেগুলো ভালো ঘুম ও শরীরকে সতেজ রাখে। হাম, টাইফয়েড রোগীর জন্য এই ফল খুবই উপকারী।

☆ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াঃ
যেকোনো কিছুই অতিরিক্ত পরিমাণ শরীরের জন্য খারাপ হতে পারে। সুস্থ ব্যক্তি প্রতিদিন ১০-১৫ গ্রাম পানিফল খেতে পারেন। অতিরিক্ত খেলে পেটফাঁপা হতে পারে। সেইসাথে পেট ব্যথাও শুরু হতে পারে। যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য রয়েছে তারা এই ফল খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন।

ড. উজ্জল কুমার নাথ
প্রফেসর
কৌলীতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ময়মনসিংহ