সর্বশেষঃ

প্রকাশ্যে এল ইরানি বিজ্ঞানী ফাখরিজাদেহের অবিশ্বাস্য হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা

মোহসেন ফাখরিজাদেহ, যাকে ইরানের পরমাণু শক্তির জনক বলা হয়। গত বছরের নভেম্বরে গুপ্তহত্যার শিকার হন। এতদিন ইরান এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে সরাসরি দোষারোপ করলেও বিষয়টি কীভাবে ঘটে তা নিয়ে ধোয়াশা ছিলই। তবে এবার প্রকাশ্যে এল সেই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা।

মার্কিন গণমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ ও ইসরায়েলি পত্রিকা ‘টাইমস অব ইসরায়েল’ এ নিয়ে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী অত্যানুধিক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফাখরিজাদেহকে হত্যা করা হয়। অবিশ্বাস্য ওই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে মাত্র ৬০ সেকেন্ডের কম সময়ে নিয়েছিল ইসরায়েলি ঘাতক বাহিনী। সে সময় ঘটনাস্থলে কোনও আততায়ী উপস্থিত ছিল না। এটি ছিল রিমোট কন্ট্রোল কিলিং-মিশন, যা হাজার মাইল দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই হামলা এতটাই সূক্ষ্ণ ছিল যে, গাড়িতে ফাখরিজাদেহের পাশের সিটে বসে থাকা স্ত্রী কিংবা তার দেহরক্ষীদের কারও গায়ে কোনও আঁচড় পর্যন্ত লাগেনি।

হামলার বিষয়ে আগে থেকেই অবগত থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলের উন্নত প্রযুক্তির ফাঁদে ধরাশায়ী হয় ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা। এমনকি হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমদিকে পুরো ঘটনা বুঝে উঠতেও ইরানের বেশ কিছু সময় লাগে।

গণমাধ্যমগুলোতে শুরুতে গানম্যানের গুলিতে ফাখরিজাদেহের নিহত হওয়ার সংবাদ প্রচার করা হলেও পরবর্তীতে রিমোট কন্ট্রোলড মেশিনগানের বিষয়টি সামনে আসে।
দীর্ঘদিনের টার্গেট ছিলেন ফাখরিজাদেহ

ইরানে ফাখরিজাদেহকে মানুষ সেভাবে না চিনলেও শত্রুপক্ষ তাকে ভালোমতোই জানত। পশ্চিমাদেশসমূহ ও ইসরায়েলের কাছে তিনি ছিলেন ইরানের পরমাণু শক্তির জনক। আর তাই, দীর্ঘ সময় ধরেই তাকে হত্যার চেষ্টা করে আসছিল মোসাদ।

আমেরিকান, ইসরায়েলি ও ইরানিয়ান কর্মকর্তাদের নেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৭ সাল থেকেই ফাখরিজাদেহের ওপর নজর রাখছিল ইসরায়েল।

মোহসেন ফাখরিজাদেহর গতিবিধি, কর্মস্থল সবকিছুর ওপরেই ছিল তাদের নজরদারি। ২০১৯ সালের শেষে শুরু হয় তাকে হত্যার পরিকল্পনা। মোসাদের তৎকালীন পরিচালক ইয়োশি কোহেন, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তা এমনকি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং সিআইএ পরিচালক জিনা হ্যাসপেল ফাখরিজাদেহকে হত্যা পরিকল্পনার একাধিক আলোচনায় অংশ নেন।

২০২০ সালের শুরু থেকে জোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে ইসরায়েল। এর পিছে মূলত দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, জেনারেল কাশেম সোলেইমানি হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে ‘কড়া জবাব’ দেওয়ার ঘোষণা দেয় ইরান। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হন সোলেইমানি। ফলে, ইরানের পরমাণু শক্তি নিয়ে পশ্চিমাশক্তি ও ইসরায়েল সতর্ক অবস্থান নেয়।

দ্বিতীয়ত, নভেম্বরে জো বাইডেনের কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়ের বিষয়টিও ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে আসে। আর জো বাইডেন ক্ষমতায় আসলে ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তিতে ফেরার ইঙ্গিতও দেন। আর তাই, ইরানকে ঠেকাতে ফাখরিজাদেহকে হত্যার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে ইসরায়েল।

জো বাইডেন জিতলেও ফাখরিজাদেহের হত্যাকাণ্ড ইরানের পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার সকল সুযোগ ব্যর্থ করে দেবে বলেই ধারণা করেছিলেন ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

হামলার পরিকল্পনা

বেলজিয়ামে নির্মিত এফএন এমএজি মেশিনগানের সাহায্যে ফাখরিজাদেহকে হত্যা করা হয়। মেশিনগানটি রোবটিক যন্ত্রাংশের সঙ্গে যুক্ত করা ছিল, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পরিচালিত হয়। পুরো যন্ত্রব্যবস্থার ওজন ছিল প্রায় এক টনের মতো।

এই বিশাল সরঞ্জাম ও অস্ত্র ইরানের ভেতর সরাসরি নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। আর তাই বিভিন্ন পথ ব্যবহার করে যন্ত্রাংশগুলো চোরাচালানের মাধ্যমে ইরানে নিয়ে আসা হয়। এখানেই বিভিন্ন অংশ সংযোজনের মাধ্যমে দাঁড় করানো হয় পুরো ব্যবস্থাপনা । মোসাদের দল পুরো পরিকল্পনা ইরানের বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান স্থাপনের জন্য সাদামাটা একটি পিকআপ ট্রাক বেছে নেয় ইসরায়েল। ইসরায়েলের সঙ্গে কাজ করা ইরানি এজেন্টরা নির্দিষ্ট রাস্তায় পিকআপ ভ্যানটি দাঁড় করিয়ে রাখে। ইরানের রাস্তায় নিসান জামইয়াদের এরকম বহু পিকআপ ভ্যানের দেখা মেলে। আর তাই এই গাড়ি নিয়েও কারও কোনও মাথাব্যথা ছিল না।

আক্রমণ চালানোর জন্য ইউটার্নের একটি রাস্তা বেছে নেওয়া হয়। ট্রাকে অসংখ্য ক্যামেরা স্থাপন করা ছিল। একইসঙ্গে রাখা হয়েছিল বিস্ফোরক। হত্যাকাণ্ডের পরপরই বিস্ফোরণের সাহায্যে ট্রাক এবং অস্ত্র উড়িয়ে দিয়ে সমস্ত চিহ্ন মেটানোর পরিকল্পনা ছিল মোসাদের।

হামলার বিবরণ

৫৯ বছর বয়সী পদার্থবিদ ফাখরিজাদেহ ইসলামিক রেভুল্যুশনারি গার্ড করপসের কর্মকর্তা এবং তেহরানের ইমাম হুসেইন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ছিলেন।

ঘটনার দিন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কাস্পিয়ানের তীরে আবসার্দের বাড়িতে ছুটি কাটাতে যাচ্ছিলেন ফাখরিজাদেহ। স্ত্রীকে পাশের সিটে বসিয়ে নিজের কালো রঙের নিসান টিয়ানা সিদান গাড়িটি তিনি নিজেই চালাচ্ছিলেন। সামনে ও পেছনে ছিল নিরাপত্তায় নিয়োজিত দেহরক্ষীদের পৃথক গাড়ি।

ফাখরিজাদেহকে সতর্ক করা সত্ত্বেও তিনি সেদিন বের হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাকে সম্ভাব্য হত্যার কথা জানিয়ে নিরাপত্তা দল গাড়ি চালাতে বারণ করলেও তিনি তা শোনেননি। বছরের পর বছর ধরে নিরাপত্তা হুমকিতে থাকা ফাখরিজাদেহের কাছে এসব সতর্কবার্তা মামুলি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২০০৯ সালেও তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে মোসাদ। কিন্তু ঝুঁকি থাকায় পরবর্তীতে সেই অভিযান বাতিল করা হয়।

ইরানে কারও ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা ইসরায়েলের জন্য কঠিন। এখানে ড্রোন ওড়ানো ইসরায়েলের পক্ষে অসম্ভব। আর তাই ফাখরিজাদেহ আসলেই ড্রাইভিং সিটে আছেন, নাকি তার স্ত্রী বা সন্তান কেউ গাড়ি চালাচ্ছেন, তা আগে থেকে জানা সম্ভব ছিল না। ইউটার্নের কাছে এজন্য নজরদারির জন্য ক্যামেরা নিয়ে অপর একটি গাড়ির ব্যবস্থা রাখে ইসরায়েলি এজেন্টরা।

ঠিক সাড়ে তিনটার সময় গাড়ি ইউটার্ন নিলে অপর গাড়িটি ফাখরিজাদেহের অবস্থান নিশ্চিত করে। হামলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা দলটি এবার সতর্ক হয়।

হামলা সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলায় হয়, “হত্যাকারী একজন দক্ষ স্নাইপার। অবস্থান গ্রহণের পর বন্দুকের নিশানা ঠিক করে তিনি আলতোভাবে ট্রিগারে স্পর্শ করেন। তবে, এর সবটাই ঘটে ইরানের বাইরে অন্তত হাজার মাইল দূরের কোনো অজ্ঞাত স্থান থেকে। ”

দূর-নিয়ন্ত্রিত অস্ত্রের মাধ্যমে হামলা চালানো হলেও হামলাকারীদের সামনে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতা ছিল। এমনকি এক মুহূর্তের বিলম্বের কারণে পুরো অভিযান ব্যর্থ হতে পারত। চলন্ত গাড়ির গতি বা অস্ত্র চালনার পর ট্রাক কেঁপে ওঠায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। একইসঙ্গে, হামলাকারীরা স্ক্রিনের মাধ্যমে ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করছিলেন। যদিও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ঘটনাস্থলের দৃশ্য আলোর বেগে স্ক্রিনে আসছিল, তাও সেখানে কয়েক মুহূর্তের বিলম্ব ছিল। পুরো ব্যবস্থাই তাই এমনভাবে সাজানো হয় যেন সময় বা গতির কারণে কোনও কালবিলম্ব না ঘটে।

ফাখরিজাদেহের গাড়ি ইউটার্ন নেওয়ার পর নিরাপত্তারক্ষীদের একটি গাড়ি আগে চলে যায়। বাড়িতে প্রবেশের আগে বাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দলটি এগিয়ে যায়। এর ফলে ফাখরিজাদেহের গাড়ির সামনের অংশ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। পার্ক করা ট্রাকের আগে থাকা স্পিডব্রেকারের কারণে নিরাপত্তাকর্মীদের অন্য গাড়িগুলোর গতিও কমে যায়। এবার, হামলাকারীদের সামনে ড্রাইভিং সিটে থাকা ফাখরিজাদেহকে গুলি করতে আর কোনও বাধা থাকে না। হঠাৎ করে গাড়ির উইন্ডশিল্ডের নিচে অজস্র বুলেট এসে আঘাত হানে।

প্রথমবার ছোড়া এই গুলি ফাখরিজাদেহকে আহত করে কি না, তা নিশ্চিত না হলেও গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে একসময় থেমে যায়। গাড়ির দরজা খুলে হামাগুড়ি দিয়ে মাথানিচু করে বেরিয়ে আসেন ফাখরিজাদেহ। ঠিক সেই সময় তাকে লক্ষ্য করে আরও তিনটি গুলি ছোড়া হয়। গুলিগুলো তার মেরুদণ্ড ভেদ করে। রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন মোহসেন ফাখরিজাদেহ।

একজন দেহরক্ষী ছুটে আসলেও আশেপাশে কাউকে না দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েন।

ফাখরিজাদেহের স্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে তার কাছে ছুটে আসেন। স্বামীর পাশে রাস্তায় বসে পড়েন তিনি। ঠিক সেই মুহূর্তে বিস্ফোরিত হয় কাছে দাঁড় করানো অস্ত্রবাহী সেই নীল ট্রাক। এই একটি জায়গায় এসে ইসরায়েলের পরিকল্পনা ঠিকমতো কাজ করেনি। বিস্ফোরণে অস্ত্র ও যন্ত্রাদি অকেজো হয়ে পড়লেও সেগুলো প্রায় অক্ষত থাকে।

মোট ১৫টি বুলেট ছোড়া হয়েছিল ফাখরিজাদেহকে হত্যা করতে। পুরো ঘটনাটি ৬০ সেকেন্ডেরও কম সময়ে ঘটেছে বলে জানিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। তবে, বাকিরা কেউ আহত হননি।

পুরো অপারেশনটি সফল হয়। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, এই অভিযানের মধ্য দিয়ে ইরানের রেভুল্যুশনারি গার্ডের নিরাপত্তা ব্যবস্থা চরমভাবে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। একইসঙ্গে, আবারও নজরদারি ও সুপরিকল্পনা দিয়ে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করে মোসাদ। তবে, ফাখরিজাদেহের মৃত্যুর পেছনে অদৃষ্টবাদী ভূমিকাও কম নয়। সেদিন তিনি সতর্কবার্তা শুনে ঘর থেকে না বের হলে হয়তো পুরো ঘটনাই এড়ানো সম্ভব হতো। সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস ও দ্য টাইমস অব ইসরায়েল