আনারসের পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারীতাঃ
আনারস এক প্রকারের গুচ্ছফল। এর অন্যান্য নাম – Pineapple, Anannas, Ananus, Bahunetraphalam, Anamnasam। এর বৈজ্ঞানিক নামঃ Ananas comosus (L.) Merr. এই ফলের আদি জন্মস্থল দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ। তবে বর্তমানে ক্রান্তীয় অঞ্চলে বিশ্বের সর্বত্রই এর চাষের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। মৌসুমী ফল আনারস। প্রতিবছর আনারসে ভরে যায় বাজার। দেশের বিভিন্ন জেলাতে চাষ হয় আনারসের। আমাদের দেশের মানুষের কাছে খুবই জনাপ্রিয় একটা ফল এটি। আনারস দেখতে যেমন সুন্দর তেমন স্বাদেও খুবই মজাদার একটি ফল। আনারসের রয়েছে অসাধারণ কিছু পুষ্টি উপাদান।
পুষ্টিগুণে আনারস অতুলনীয়। আনারসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ এ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান। যেগুলো শরীরের কোষকে ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। ফলে অথেরোস্ক্লেরোসিস, হার্ট রোগ, বাত এবং বিভিন্ন ক্যান্সার থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়।
পুষ্টিগুণঃ
প্রতি ১০০ গ্রামে আনারসে পাওয়া যায় ৫০ কিলোক্যালরি শক্তি। এতে ভিটামিন-এ, বি, সি, ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান রয়েছে। ১০০ গ্রাম আনারসে ০.৬ ভাগ প্রোটিন, ০.১২ গ্রাম সহজপাচ্য ফ্যাট, ০.৫ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ১৩.১২ গ্রাম শর্করা, ০.১১ গ্রাম ভিটামিন বি-১, ০.০৪ মি. গ্রাম ভিটামিন-২, ভিটামিন- সি ৪৭.৮ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৮ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ০.০২ গ্রাম, আঁশ ১.৪ গ্রাম এবং ১.২ মিলি গ্রাম লৌহ রয়েছে।
আনারসের স্বাস্থ্য উপকারীতা সমূহ :
১। চোখের স্বাস্থ্য রক্ষায়
আনারস চোখের জন্য খুবই ভালো যা দৃষ্টিশক্তির উন্নতিতে সাহায্য করে। বয়স বৃদ্ধির ফলে চোখের সমস্যা ম্যাকুলার ডিজেনারেশন হয় একে প্রতিরোধ করতে পারে আনারসে উপস্থিত পুষ্টি উপাদান। আনারস খেয়ে আপনার দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে পারেন।
২। সুস্থ হাড়
আনারস কপার ও ম্যাঙ্গানিজের মত খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। এই খনিজ উপাদান সমূহ হাড়কে সুস্থ রাখে এবং বিভিন্ন প্রকার হাড়ের অসুখ প্রতিরোধ করে। বয়সজনিত হাড়ের দুর্বলতা প্রতিরোধ করে আনারস। বাড়ন্ত শিশুর হাড়ের জন্যও আনারস ভালো। ১৯৯৪ সালের একটি গবেষণার ফলাফলে জানা যায় যে,ম্যাঙ্গানিজ অন্য খনিজ উপাদানের সাথে মিলিত হয়ে মহিলাদের মেনোপোজ পরবর্তী অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ করতে পারে। Oregon State University এর Linus Pauling Instituteএর মতে, “আনারস আপনাকে লম্বা ও শক্তিশালী রাখতে সাহায্য করে, দৈনিক চাহিদার ৭৫ শতাংশ ম্যাঙ্গানিজ সরবরাহ করে এই ফল, যা অস্থি ও সংযোগ কলার উন্নয়নে অত্যাবশ্যকীয়”।
৩। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
আপনার দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি করতে পারে আনারস। আনারসে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে যা ইমিউন সিস্টেমকে উন্নত করে। তাই আনারস খেলে ইমিউনিটি শক্তিশালী হয় এবং জীবাণুর আক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করে।
৪। এনার্জি প্রদান করে
অনেক মানুষ আছেন যারা এনার্জি কমে যাওয়া, অবসাদ ও ক্লান্ত অনুভব করা ইত্যাদি সমস্যা গুলোয় ভোগে থাকেন। আনারসের ম্যাঙ্গানিজ এনার্জি উৎপাদনে শরীরকে সাহায্য করে। আমাদের শরীরে যে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এনার্জি উৎপন্ন হয় তার জন্য ম্যাঙ্গানিজ প্রয়োজন। আর আনারস এই প্রয়োজনীয়তা কে পূরণ করতে পারে। এতে ভিটামিন বি থাকে যা স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।
৫। শ্লেষ্মা বা সর্দি পরিষ্কার করে
যারা দীর্ঘ দিনের কফের সমস্যায় ভুগছেন তারা আনারসের জুস খেলে পরিত্রাণ পেতে পারেন। আনারসে ভিটামিন সি এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থাকে যা গলা থেকে মিউকাস সরে যেতে সাহায্য করে। আনারস ফুসফুসের মিউকাস দূরীকরণেও সহায়তা করে।
৬। মুখের সুরক্ষায়
আনারসের পুষ্টি উপাদান মাড়িকে শক্তিশালী করে ও মাড়ির রোগ প্রতিরোধ করে। দাঁত নড়বড়ে হয়ে যাওয়া রোধ করে। আনারসের অ্যাস্ট্রিনঞ্জেন্ট উপাদান মাড়িকে শক্ত ও টান টান করে।
৭। ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষায়
আনারস ত্বকের জন্য উপকারী। ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা যেমন- ব্রণ প্রতিরোধ করতে পারে আনারসের পুষ্টি উপাদান। আনারসের ভিটামিন সি ত্বকের ইনফ্লামেশন প্রতিরোধ করে। আনারসের পুষ্টি উপাদান কোলাজেন উৎপাদনে সহায়তা করে যা ত্বককে স্বাস্থ্যবান ও তরুণ রাখে। এছাড়াও আনারসের পুষ্টি উপাদান ত্বকের আর্দ্রতা রক্ষা করে ত্বকের শুষ্কতা রোধ করে।
৮। স্বাস্থ্যবান চুলের জন্য
আনারসে ভিটামিন সি থাকে যা চুল পড়ার সমস্যা দূর করতে পারে। আনারস খেলে চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় এবং মাথার তালুর ইনফেকশন প্রতিরোধ করতে পারে। ঘন ও শক্তিশালী চুল পেতে চাইলে আনারস খাওয়া উচিৎ।
৯। ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
যারা ওজন কমানোর জন্য সংগ্রাম করছেন তারা আনারস ক্ষেতে পারেন। কারণ আনারসে ক্যালরি কম থাকে এবং কোন ফ্যাট থাকেনা। আনারস কোলেস্টেরল মুক্ত এবং প্রচুর ফাইবার সমৃদ্ধ। তাই ওজন কমানোর জন্য আনারস চমৎকার খাদ্য।
১০। পুষ্টির অভার দূর করেঃ
এটি পুষ্টির বেশ বড় একটি উৎস। আনারসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ এবং সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ফসফরাস। এসব উপাদান আমাদের দেহের পুষ্টির অভাব পূরণ করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
১১। দাঁত ও মাড়ি সুরক্ষায়ঃ
আনারসের ক্যালসিয়াম দাতের সুরক্ষায় কাজ করে। মাড়ির যে কোন সমস্যা সমাধান করতে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন আনারস খেলে দাতে জীবাণুর আক্রমণ কম হয় এবং দাত ঠিক থাকে।
১২। হজমশক্তি বাড়ায়ঃ
আনরস আমাদের হজমশক্তি বৃদ্ধি করতে বেশ কার্যকর। আনারসে রয়েছে ব্রোমেলিন, যা আমাদের হজমশক্তিকে উন্নত করতে সাহায্য করে। বদহজম বা হজমজনিত যেকোন সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে প্রতিদিন এটা খাওয়া অত্যন্ত জরুরি।
১৩। রক্ত জমাটে বাধা দেয়ঃ
দেহে রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয় এই ফল। ফলে শিরা ধমনির দেয়ালে রক্ত না জমার জন্য সারা শরীরে সঠিকভাবে রক্ত যেতে পারে। হৃদপিণ্ড আমাদের শরীরে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সরবরাহ করে। আনারস রক্ত পরিষ্কার করে হৃদপিণ্ডকে কাজ করতে সাহায্য করে।
স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী আনারস আরো যে রোগ সমূহের নিরাময়ে কাজে লাগে তা হল- রক্তচাপ কমিয়ে হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণ করে, আনারসের ব্রোমেল্যাইন শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। সাইনাস ইনফেকশন ও ব্রংকাইটিস প্রতিরোধে কাজ করে, নেজাল ইনফ্লামেশন কমায়, ব্রোমেল্যাইন এনজাইম খাদ্য হজমে সহায়তা করে, আনারসের পুষ্টি উপাদান রক্ত জমাটে বাঁধা প্রদান করে তাই রক্তক্ষরণের সমস্যা প্রতিরোধে কাজ করে, আনারসে পটাসিয়াম থাকে যা রক্ত সংবহনকে উন্নত করতে পারে, আনারসে ক্যান্সার বিরোধী উপাদান আছে যা বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সার যেমন- কোলন কেন্সার, মুখ ও গলার ক্যান্সার এবং ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে।
☆ সতর্কতাঃ
আনারস সবার জন্য ঠিক স্যুট করে না। অনেকেরই আনারস খেলে হতে পারে এলার্জি। ফলে বিভিন্ন ধরনের চুলকানি, ফুস্কুরি ইত্যাদি হয়ে থাকে। তাই যাদের আনারস খেলে এ সকল সমস্যায় ভুগেন তারা অবশ্যই আনারস থেকে দূরে থাকবেন।
আনারসে রয়েছে প্রচুর পরিমানে প্রাকৃতিক চিনি। আনারসের ২ টি উপাদান সুক্রোজ এবং ফ্রুক্টোজ যা ডায়বেটিস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু দেহের ক্ষতি, এটি খাওয়ার উপর নির্ভর করে। এবং আনারসের মধ্যে অতিরিক্ত চিনি আমাদের দেহে রক্তের চিনির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। তাই আনারস বেশি না খেয়ে সপ্তাহে ২ দিন খেতে পারেন।
আনারসে আছে ব্রমিলেইন যা দিয়ে ওষুধ বানানো হয়ে থাকে এবং কোনো রোগীর প্রয়োজন পরলে তাকে তা দেয়া হয়ে থাকে। তাছাড়া আপনি যদি কোনো কারণে অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টিকনভালসেন্ট ব্যবহার করে থাকেন তাহলে আনারস খেতে ডাক্তার নিষেধ করে থাকেন। কারণ এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
Dr. Ujjal Kumar Nath
Professor
Department of Genetics and Plant Breeding
Bangladesh Agricultural University
Mymensigh