সর্বশেষঃ

উপকারী এক ফল কুল বা বরইঃ

দেশি ফলের মধ্যে বরই বেশ জনপ্রিয়। বর্তমানে আমাদের দেশে নানা জাতের বরইয়ের চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে নারকেল বরই, আপেলকুল, বাউকুল, থাইকুল আর দেশি টক বরই তো আছেই। বরই খেতে ভালোবাসেন কম বেশি সবাই। টক-মিষ্টি এই ফলটির রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ। পুষ্টিগুণ ছাড়াও এর রয়েছে অনেক রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা। চলুন জেনে নেয়া যাক বরইয়ের উপকারিতা উপকারিতা: বরই অত্যন্ত চমৎকার একটি রক্ত বিশুদ্ধকারক। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বরই খুবই উপকারী ফল। ডায়রিয়া, ক্রমাগত মোটা হয়ে যাওয়া, রক্তশূন্যতা, ব্রঙ্কাইটিস ইত্যাদি রোগ খুব দ্রুত সারিয়ে তোলে এই ফল। বরইয়ের রসকে অ্যান্টি-ক্যান্সার হিসেবে গণ্য করা হয়।

কুল, বরই বা বড়ই বৈজ্ঞানিক নাম Ziziphus zizyphus। দক্ষিণ এশিয়ায় বহুল প্রচলিত, কন্টকপূর্ণ গাছের ফল। ইংরেজিতে একে সচরাচর Jujube বা Chinese date হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র, সর্বপ্রকার মাটিতেই বরই গাছ জন্মে। একটু ডিম্বাকৃতির বরইকে সচরাচর “কুল” বলে অভিহিত করা হয়। বরই গাছ ছোট থেকে মাঝারি আকারের ঝোপাল প্রকৃতির বৃক্ষ। বরই গাছের স্বাভাবিক উচ্চতা ১২-১৩ মিটার। এই গাছ পত্রঝরা স্বভাবী অর্থাৎ শীতকালে পাতা ঝরে, বসন্তে নতুন পাতা আসে। বরই গাছের ডাল-পালা ঊর্ধ্বমুখী। বৎসরের সেপ্টেম্বরে – অক্টোবরে মৌসুমে গাছে ফুল আসে। ফল ধরে শীতে। ফল গোলাকার, ছোট থেকে মাঝারি। ফল আকারে ছোট, কমবেশী ২.৫ সেন্টিমিটার। ফল পাকলে রঙ হলুদ থেকে লাল বর্ণ হয়। কাচা ও পাকা উভয় পদের বরই খাওয়া হয়। স্বাদ টক ও কাঁচামিঠা জাতীয়। বরই রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। পাকা বরই শুকিয়ে চাটনী প্রস্তুত করা হয়।

শীত থেকে গরমের শুরু অবধি সময়টা কুলই রাজত্ব করে বাজারে। টক-মিষ্টি গোল টোপা কুল, নারকেল কুল, আপেল কুল, এমনকি স্বাদ মেটাতে আছে বাও কুল। দামও হাতের নাগালেই। পুষ্টিবিদেরা বলেন, কুলে আছে প্রচুর ভিটামিন আর খনিজ উপাদান।

বাংলার প্রায় সব জায়গায় সব ধরনের মাটিতে কুল জন্মে। এটি শুকিয়ে অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায়। কাঁচা ও শুকনো কুল দিয়ে চমৎকার চাটনি ও আচার তৈরি করা যায়। পুষ্টিগুণের জন্য কুল তো খাবেনই; আরও একটা কারণে কুল খেতে পারেন। তা হলো এটি দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।

কুলে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম সহ আছে নানা উপাদান। এগুলো রোগ প্রতিরোধে যেমন ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয়। কুল সবার জন্য ভালো হলেও ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য কিন্তু নয়। পাকা কুলে চিনি থাকে, তাই ডায়াবেটিসের রোগীদের পাকা বরই সাবধানে খাওয়াই ভালো। আর যাঁদের শ্বাসকষ্ট আছে, কাঁচা কুল বেশি খেয়ে ফেললে তাঁদের এ সমস্যা কিন্তু বেড়ে যেতে পারে।

পুষ্টিগুণঃ

প্রতি ১০০ গ্রাম খাওয়ার উপযোগী বরইয়ে খাদ্যশক্তি আছে ৭৯ কিলোক্যালরি, শকর্রা ২০.২৩ গ্রাম, আমিষ ১.২ গ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম, জলীয় অংশ ৭৭.৮৬ গ্রাম, থায়ামিন ০.০২ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন ০.৯ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাভিন ০.০৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ ৪০ আইইউ, ভিটামিন বি৬ ০.০৮১ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৬৯ মিলিগ্রাম, আয়রন ০.৪৮ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ২১ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ১০ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ২৩ মিলিগ্রাম, ম্যাংগানিজ ০.০৮৪ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২৫০ মিলিগ্রাম, জিংক ০.০৫ মিলিগ্রাম এবং সোডিয়াম ৩ মিলিগ্রাম। এ উপাদানগুলো শরীরের বিভিন্ন অসুখ সারাইয়ের কাজ করে।

উপকারীতাঃ

১। ক্যান্সার প্রতিরোধ
বরই এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান বিদ্যমান, যারা টিউমারের উপর সাইটোটক্সিক প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে শরীরে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

২। রক্ত পরিশুদ্ধি
শুকনো বরই এর মধ্যে স্যাপোনিন, অ্যাল্কালয়েড এবং ট্রাইটারপেনয়েড উপাদান থাকে যারা রক্ত পরিশুদ্ধ করে এবং হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে।

৩। রোগ প্রতিরোধে কাজ করে
বরইয়ে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসহ আরও অনেক উপকারী উপাদান থাকে। যা আমাদের রোগ প্রতিরোধে যেমন ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয়। এর ভেতরে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের ফ্রি র‍্যাডিকেলগুলোকে নিস্ক্রিয় করে দেয়।

৪। রক্ত পরিশুদ্ধি করে
শুকনো বরই এর মধ্যে স্যাপোনিন, অ্যাল্কালয়েড এবং ট্রাইটারপেনয়েড উপাদান থাকে যারা রক্ত পরিশুদ্ধ করে এবং হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে।

৫। ক্ষুধাবর্ধক এবং হজমে সাহায্য করে
বরই কোষ্ঠকাঠিন্যসহ অন্যান্য হজমজনিত সমস্যার সমাধান করে। ক্ষুধাবর্ধক হিসেবে কাজ করে।

৬। ওজন নিয়ন্ত্রণ
বরইতে ফ্যাট নাই বললেই চলে। ২ আউন্স (প্রায় ৪টি) বরই খেলে শরীরে ৪৪ ক্যালরি শক্তি যোগান দেয়, কিন্তু ফ্যাট প্রায় শূন্য। ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণেও এরা সাহায্য করতে পারে।

৭। উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোধ করে
কুল অত্যন্ত চমৎকার একটি রক্ত বিশুদ্ধকারক। উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য টক বরই উপকারী ফল।

৮। হাড় মজবুত করে
বরই একই সঙ্গে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও আয়রন সমৃদ্ধ হওয়ায় হাড় গঠনে এবং দাঁতের সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে। যা হাড় শক্ত ও মজবুত করতে সাহায্য করে।

৯। ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রা দূর করে
বরই অবসাদ এবং দুশ্চিন্তা দুর করে। ইনসোমনিয়া এবং দুশ্চিন্তা অনেক মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায়। বরই এর শক্তিশালি উপাদানগুলি অনিদ্রা এবং দুশ্চিন্তা কমিয়ে আনতে সাহায্য করে।

১০। ত্বকে ভাল রাখে
ত্বকের রুক্ষতা দূর করে ত্বককে কোমল করে বরই। রোদে পোড়া ত্বক সুরক্ষার কাজেও কার্যকর। বরই বয়সের ছাপ পড়তেও বাধা দেয়।

১১। রক্ত সঞ্চালন
আয়রন ও ফসফরাস শরীরে রক্ত উৎপাদন এবং রক্ত সঞ্চালনের প্রক্রিয়া বৃদ্ধি করে।

১২। ভিটামিন সি এর ভাল উৎস
কুলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। ফলে এটি সংক্রামক রোগ দূর করতে সহায়তা করে। যেমন: টনসিলাইটিস, ঠোঁটের কোণে ঘা, জিহ্বায় ঘা, ঠোঁটের চামড়া উঠে যাওয়া ইত্যাদি দূর করে।

১৩। লিভারের সুরক্ষা
শরীরের ফ্রি র‍্যাডিকেলগুলো লিভারের ক্ষতি করে। বরই এর মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় এটি লিভারকে সুরক্ষা প্রদান করে।

১৪। পেটের সমস্যা দূর করতে
এছাড়াও বিভিন্ন দেশে পেটের সমস্যা দূর করতে, মাংসপেশি শক্তিশালী করতে এই ফলের ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

এছাড়াও মৌসুমি জ্বর, সর্দি-কাশিও প্রতিরোধ করে কুল এমনকি হজমশক্তি বৃদ্ধি ও খাবারে রুচি বাড়িয়ে তোলে এ ফল। বিভিন্ন দেশে পেটের সমস্যা দূর করতে, মাংসপেশী শক্তিশালী করতে এই ফলের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাছাড়া যকৃতের নানা রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে এই ফল। ডায়রিয়া, ক্রমাগত মোটা হয়ে যাওয়া, রক্তশূন্যতা, ব্রঙ্কাইটিস ইত্যাদি রোগ নিরাময়ে কাজ দেয় এই ফল।

ড. উজ্জল কুমার নাথ
প্রফেসর
কৌলীতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ময়মনসিংহ