সর্বশেষঃ

করোনার মধ্যে চতুর্মুখী সংকটে নাজেহাল ভারত

একদিকে করোনা ভাইরাসে নাজেহাল ভারত, অন্যদিকে ভারত ও চীনা সেনাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায় এমনিতেই যখন টালমাটাল অবস্থা মোদি সরকারের। তার উপর সক্রিয় রয়েছে দেশটির বিভিন্ন বিরোধী দলের তীব্র সমালোচনা। এই ত্রিমুখী সংকটে ঊর্ধ্বশ্বাসে এখন মোদি সরকার।

করোনা সংকট : ভারতে করোনা সংকট দিন দিন বেড়েই চলেছে। ভারি হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। একদিনে নতুন করে মৃতের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। মৃত্যু তালিকায় যুক্তদের শীর্ষে রয়েছে মহারাষ্ট্র ও দেশটির জাতীয় রাজধানী অঞ্চল দিল্লির নাম।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতে মঙ্গলবারের চেয়ে বুধবার মৃতের সংখ্যা একদিনে ২০ শতাংশ বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৩ জনের। যা দেশটিতে একদিনে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যায় নতুন রেকর্ড। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১১ হাজার ৯১৪ জনে। এছাড়া নতুন করে ১১ হাজার ৯০৩ জনের দেহে ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। মোট আক্রান্ত এখন ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৬৫ জন।

সীমান্তে হত্যাকাণ্ড : ভারতের হিমাচল প্রদেশে চীন সীমান্ত লাগোয়া জেলাগুলোতে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। গত (সোমবার) রাতে লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত এবং চীনা সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষে কমান্ডিং অফিসার পদের কর্নেলসহ কমপক্ষে ২৩ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় গুরুতর আহত অবস্থায় আছেন দেশটির ১১০ জন জওয়ান। সীমান্তে বিরাজ করছে তুমুল উত্তেজনা। এরই মধ্যে বুধবার নিয়ন্ত্রণরেখায় চীনের আগ্রাসন মোকাবিলায় সেনাবাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে ভারত। শান্তি বজায় রাখার সম্পূর্ণ প্রচেষ্টা করা হলেও সীমান্তে ভারতের এলাকায় চীনের কোনো রকম প্রবেশ ও আগ্রাসন মেনে নেবে না বলে সাফ জানিয়ে দেশটি।

নেপাল নিয়ে বিব্রত ভারত: লাদাখে চীনের সাথে সংঘাতে চাপের মুখে রয়েছে ভারত। এর মধ্যেই সীমান্তে শক্তি বাড়ানো শুরু করেছে নেপালও। এর আগে ভারত অভ্যন্তরের তিনটি ভূখণ্ডকে নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করে নেপাল পার্লামেন্ট। এ নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে সরকার। সর্বশেষ সূত্রের খবর, ভারত-নেপাল সীমান্তে ১০০টি নতুন সেনা চৌকি বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কাঠমুণ্ডু।

বিরোধীদের তীব্র সমালোচনা: অন্যদিকে মোদি সরকারের তীব্র সমালোচনায় বিরোধিরা। ইরানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম পর্সটুডের এক প্রতিবেদনের বলা হয়েছে- ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা, সাবেক অর্থ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে বলেছেন, ‘৫ মে’র পর থেকে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে নীরব। বিদেশি সেনা ভূখণ্ড দখল করে বসে রয়েছে, অথচ দেশের প্রধান চুপ, অন্য কোনো দেশে এমন হতো বলে ভাবা যায়?’

কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সিং সূর্যেওয়ালা বলেন, ‘গতরাতে আমাদের সেনারা নিহত হলেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিল দুপুর ১২টা ৫২ মিনিটে। কিছুক্ষণ পরেই সেটি পরিবর্তন হলো। এ সব কেন হলো, জবাব চাই।’

কংগ্রেস বলেছে, ‘গালওয়ান উপত্যকায় ভারতীয় সেনাদের শহীদ হওয়ার সংবাদ প্রতিটি দেশবাসীকে কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নীরবতা বরদাস্ত যোগ্য নয়। প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী দেশবাসীর সামনে জবাবদিহি থেকে পালাচ্ছেন। মোদি সরকার সীমান্ত বিরোধ ইস্যুতে নীরব ছিল এবং দেশের মানুষকে অন্ধকারে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু আমাদের সেনাদের শহীদ হওয়ার বিষয়ে মোদি সরকারকে জবাব দিতে হবে। যদি সীমান্তে সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, তবে কোন পরিস্থিতিতে সেনাদের শহীদ হতে হয়েছিল? আমাদের সেনাদের শহীদ হওয়া নিয়ে বিভ্রান্তি কেন? মোদি সরকার কী সীমান্তে অচলাবস্থা লুকানোর চেষ্টা করছিল? ২০২০ সালের এপ্রিল/মে মাসে আমাদের এলাকার কত অংশ চীনা সেনারা দখল করেছে, দেশবাসীকে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে তা অবশ্যই অবহিত করতে হবে। এই বিষয়ে নীরব থেকে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী লুকোতে পারবেন না।’

অন্যদিকে, সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, ‘সরকারের উচিত, ঠিক কী হয়েছে সে ব্যাপারে আরো দায়িত্বপূর্ণ বিবৃতি দেয়া।’ জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতির টুইটার হ্যান্ডেলে তার মেয়ে ইলতিজা বলেন, চীনের সামনে ভারতের ‘ঘর মে ঘুসকে মারেঙ্গে’ (ঘরে ঢুকে মারা) রণনীতি কোথায় গেল? কেন প্রত্যাঘাতের কোনো কথা বলা হচ্ছে না, সেটা সবাই জানতে চায়।

পিডিপির সচিব বেদ মহাজন বলেন, ‘পাল্টা মার দরকার। এটা ১৯৬২ সাল নয়, এটা ২০২০ সাল। ওই আগের কথা বলে কোনো লাভ নেই।’ জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেন, সেনা কমানোর সময় যদি এ রকম ঝামেলা হয়, তাহলে আসলে ঠিক কতটা গণ্ডগোল রয়েছে, সেটা ভাবুন।

জম্মু-কাশ্মীরের কংগ্রেস প্রধান গুলাম আহমেদ মীর বলেন, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা যেকোনো সরকারের কর্তব্য। সরকারের উচিত ক‚টনৈতিকভাবে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা। অন্যথায় সেনাকে নির্দেশ দেয়া হোক আমাদের ভূমি সুরক্ষিত করার জন্য।

এদিকে সরকারি সূত্রকে উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমে প্রকাশ, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে সীমান্তের পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের। গত সোমবার লাদাখ সীমান্তে তীব্র সংঘর্ষের পরে বস্তুত চীনের অবস্থান আরো কঠোর হয়েছে।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কার্যত হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, ভারত যেন একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ভুল না করে। চীন শান্তি চায়। তবে চীন ভয় পায় না। পাল্টা জবাবে ভারত বলেছে, চীন চাইলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। ভারত সর্বদা নিজের সার্বভৌম ভ‚খণ্ডেই সীমাবদ্ধ থাকে। আমরা আশা করি, চীনও সেই নীতিই মেনে চলবে।

এদিকে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষের জেরে ভারতের হিমাচল প্রদেশে অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। নিরাপত্তা এজেন্সিগুলো সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। চীন সীমান্ত লাগোয়া কিন্নৌর, লাহৌল-স্পিতিতে সতর্কতা জারি করেছে প্রশাসন। পুলিশ সদর দফতর থেকে উভয় জেলার পুলিশ সুপারকে অতিরিক্ত সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বনের জন্য নির্দেশ জারি করা হয়েছে।

অন্যদিকে, লাদাখে চীনা ও ভারতীয় সেনাদের রক্তক্ষয়ী ও প্রাণঘাতী সংঘর্ষের ঘটনার পর বিরোধ নিরসনে উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড ত্যাগ করে ভারতকে সংলাপ ও আলোচনার সঠিক পথে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছে চীন। চীনের সরকারি বার্তা সংস্থা সিন হুয়া এ তথ্য জানায়।

শান্তি আলোচনার আহ্বান চীনের: ভারত-চীন সংকট মোকাবিলায় সংঘাতের পথ বর্জন করে শান্তি আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে চীন। মঙ্গলবার চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডার ঝিয়াং সুলি এক বিবৃতিতে বলেছেন, সীমান্তে নিয়োজিত সেনাদের ভারতকে অবশ্যই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

কমান্ডার ঝিয়াং সুলি এক বিবৃতিতে বলেছেন, গত সোমবার রাতে চীন ও ভারতীয় সেনা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের আগে ভারতের সেনারা বেআইনিভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে আক্রমণ চালায়। ভারতীয় সেনা বাহিনী তাদের প্রতিশ্রতি ভঙ্গ করে উস্কানিমূলকভাবে চীনা সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করে।

তিনি বলেন, আমরা দাবি করছি, ভারতের সেনা বাহিনী অতিসত্তর সীমান্ত থেকে সরে যেতে হবে এবং সব উস্কানিমূলক তৎপরতা বন্ধ করে চীনের সঙ্গে সমস্যা সমাধানের আলোচনা আসতে হবে।

সংযমের আহ্বান জাতিসংঘের: ভারত-চীন সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি দুদেশকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। মঙ্গলবার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে অংশ নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের পক্ষে তার মুখপাত্র এরিক কানেকো এই আহ্বান জানান।

ভারত-চীন বিরোধের কারণ : চীন এবং ভারত দুটি দেশই সামরিক শক্তিতে বিশ্বের অন্যতম। কাশ্মীরের লাদাখ অঞ্চলের উঁচু, অপেক্ষাকৃত জনবসতিহীন এলাকার সীমান্ত নিয়ে কয়েক দশক ধরেই এই দুই দেশের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। এর আগে দুই দেশের ৩,৪৪০ কিলোমিটার সীমান্তের বিভিন্ন অংশে সৈন্যরা সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে এবং বেশ কয়েকবার সীমান্তে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে।

সাম্প্রতিক সংঘাতের কারণ লাদাখে ভারতের তৈরি একটি রাস্তা, যেটি দুই দেশের মধ্যকার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওএসি) বরাবর অবস্থিত। ভারত অভিযোগ করে আসছিল, চীন লাদাখের সীমান্তরেখা অনৈতিকভাবে ব্যবহার করে আসছে। তারপর ভারত সেখানে তাদের সেনা মোতায়েন করে।

কেন এই ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ : ভারত ও চীন দুই দেশই বিরোধপূর্ণ সীমান্ত অঞ্চলকে কৌশলগতভাবে, সামরিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে। এখন কোনো পক্ষই যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছাড় না দেয়, তাহলে এই সামরিক অবস্থান ওই অঞ্চলের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এর মধ্যে প্রাণহানির ঘটনা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। ধারণা করা হচ্ছে গত ৪৫ বছরে ভারত-চীন সীমান্ত সংঘাতে এই প্রথম প্রাণহানির ঘটনা ঘটলো। দুই দেশ ১৯৬২ সালে একবারই নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করেছিল, যেখানে ভারত শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।

পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে : চলমান উত্তেজনা স্তিমিত করার আলোচনা সফল না হলে পরিস্থিতি খুবই আশঙ্কাজনক মোড় নিতে পারে। সীমান্তে বিরোধ নিরসনের উদ্দেশ্যে চীন ও ভারতের সেনাবাহিনীর জেনারেলরা সম্প্রতি আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। তবে অতীতে এ ধরনের আলোচনা কার্যকর হয়নি। আলোচনা সফল না হলে পারমাণবিক শক্তিধর ও পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ দুটির মধ্যে বৈরিতা আরো বাড়তে পারে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক কমান্ডার ডিএস হুদা সোমবারের সংঘর্ষ সম্পর্কে বলেন, ‘এটি খুবই, খুবই গুরুতর। এই ধরনের সংঘাত যে কোনো আলোচনাকে ব্যর্থ করে দিতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *