সর্বশেষঃ

জাম্বুরার বিস্ময়কর পুষ্টিগুণ ও উপকারীতাঃ

বাতাবি লেবু ফলটি জাম্বুরা নামে বেশি পরিচিত। জাম্বুরার বৈজ্ঞানিক নাম citrus maxima আর ইংরেজি নাম Pomelo। বাংলাদেশে জাম্বুরা বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন বড় লেবু, বাদামি লেবু, ছোলম ইত্যাদি। যত প্রকার লেবু আছে তার মধ্যে জাম্বুরা সর্বাপেক্ষা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। টক-মিষ্টি রসাল ফল জাম্বুরা প্রচুর পুষ্টিগুণে ভরপুর। বর্ষার শেষে, শীত আসার আগ পর্যন্ত জাম্বুরার মৌসুম। এখন বাজারে প্রচুর জাম্বুরা পাওয়া যাচ্ছে।
জাম্বুরা বা বাতাবি লেবু—যাই বলি না কেন ফলটি খুবই ভিটামিনসমৃদ্ধ একটি ফল। প্রতিদিন একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের যতটা ভিটামিন ‘সি’ প্রয়োজন, একটা জাম্বুরাতে তার চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। ঠান্ডা, সর্দি-জ্বর ইত্যাদি সমস্যায় জাম্বুরা বেশ উপকারী। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।
যাঁরা গ্রামে বড় হয়েছেন, তাঁরা জানেন। অনেকেই ফুটবলের অভাব পূরণ করেছেন বাতাবি লেবু বা জাম্বুরা দিয়ে ছোটবেলায় জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল বানিয়ে বৃষ্টি-কাদায় গড়াগড়ি খেয়েছেন। কখনো জাম্বুরার খোলস হয়েছে মাথার টুপি। তবে সেই জাম্বুরার কদর এখন বেড়েছে।
জাম্বুরার কোয়ার খোসা সুদ্ধই খেতে হয় এই ফল। ফলে রসের সঙ্গে সঙ্গে অনেক আঁশও খাওয়া হয়ে যায়। এই আঁশ হজম ও বিপাকক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে, ওজন কমাতে সাহায্য করে এবং অন্ত্রের ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। বাতাবি লেবুর খাদ্য উপাদান যাদের গ্যাসিডিটি বা গ্যাস আছে তাদের জন্য বেশ উপকারী। তাছাড়াও বাতাবি লেবুতে আছে বায়োফ্লভনয়েড যা ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে মানুষকে রক্ষা করে।
গবেষকদের মতে, জাম্বুরায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম। এছাড়া ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি ছাড়াও পাইরিডক্সিন, ফলিক এসিড ও থায়ামিন রয়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। সামান্য পরিমাণে ফসফরাস, আয়রন, ক্যালসিয়াম ও কপার রয়েছে। এ ফলটিতে আরও রয়েছে বিটা ক্যারোটিন, লাইকোপেন, লিউটিন ও জ্যান্থিন।

পুষ্টিগুণঃ

প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্য যোগ্য জাম্বুরায় রয়েছেঃ খাদ্যশক্তি ৩৮ কিলোক্যালরি। প্রোটিন ০.৫ গ্রাম। স্নেহ ০.৩ গ্রাম। শর্করা ৮.৫ গ্রাম। খাদ্যআঁশ ১ গ্রাম। থায়ামিন ০.০৩৪ মিলি গ্রাম। খনিজ লবণ ০.২০ গ্রাম। রিবোফ্লেভিন ০.০২৭ মিলি গ্রাম। নিয়াসিন ০.২২ মিলি গ্রাম। ভিটামিন বি২ ০.০৪ মিলি গ্রাম। ভিটামিন বি৬ ০.০৩৬ মিলি গ্রাম। ভিটামিন সি ১০৫ মিলি গ্রাম। ক্যারোটিন ১২০ মাইক্রো গ্রাম। আয়রন ০.২ মিলি গ্রাম। ক্যালসিয়াম ৩৭ মিলি গ্রাম। ম্যাগনেসিয়াম ৬ মিলিগ্রাম। ম্যাংগানিজ ০.০১৭ মিলিগ্রাম। ফসফরাস ১৭ মিলিগ্রাম। পটাশিয়াম ২১৬ মিলিগ্রাম। সোডিয়াম ১ মিলিগ্রাম।

জাম্বুরা খাওয়ার উপকারীতাঃ

১। জাম্বুরা ফোলিক এসিডের উৎস
জাম্বুরা উচ্চ পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন এবং ফোলিক এসিডের উৎস।আর,এই দুটি উপাদানই গর্ভবতী মায়েদের জন্য উপকারী।সুতরাং,গর্ভস্থ শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত জাম্বুরা খান।

২। পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ
জাম্বুরাতে রয়েছে ভিটামিন-এ,ভিটামিন-বি১,ভিটামিন-বি২,বায়োফ্লাভোনয়েডস,অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট,হেলদি ফ্যাট,প্রোটিন এবং এনজাইমস।

৩। দাঁতকে শক্তিশালী করে
জাম্বুরাতে থাকা ভিটামিন-সি দাঁতের ব্যাথা দূর করতে এবং দাঁতের মাড়ি শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।সুতরাং,যাদের দাঁতের সমস্যা বেশি তারা খাদ্য তালিকায় জাম্বুরা অন্তর্ভুক্ত করুন।

৩। প্রাকৃতিক রেমেডিস
জাম্বুরাতে রয়েছে সাধারণ ঠাণ্ডা,জ্বর বা কাশি দূর করার প্রাকৃতিক রেমেডিস।সুতরাং,একটু জ্বর,কাশি বা ঠাণ্ডা হলেই যারা মুঠো ভর্তি মেডিসিন খেয়ে অভ্যস্ত তারা জাম্বুরা খেলে খুব দ্রুত উপকার পাবেন। জাম্বুরায় প্রচুর ভিটামিন-সি রয়েছে। এটি রক্তনালির সংকোচন-প্রসারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ডায়াবেটিস, জ্বর, নিদ্রাহীনতা, মুখের ভেতরে ঘা, পাকস্থলী ও অগ্ন্যাশয়ের বিভিন্ন রোগের উপশমকারী।

৪। হার্টকে সুস্থ রাখে
জাম্বুরাতে রয়েছে উচ্চ পরিমাণে পটাশিয়াম যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করতে এবং হার্টকে ভাল রাখতে জরুরী।এছাড়া, জাম্বুরাতে উচ্চ পরিমাণে পেক্টিন রয়েছে যা আর্টারিয়াল ডিপোজিট ক্লিয়ার করতে সাহায্য করে।ফলে,হার্ট সুস্থ থাকে।

৫। পেশীর টান লাগা দূর করে
পানি পানের অভাব,ডিহাইড্রেশন এবং ইলেক্ট্রলাইটস ইম্ব্যালেন্সের কারণে আমাদের মাসেল ক্রাম্প হয়।আর,যাদের প্রায় মাসেল ক্রাম্প অর্থাৎ পেশীতে টান লাগে,তারা নিয়মিত জাম্বুরা বা জাম্বুরার রস খেতে পারেন।জাম্বুরা বেশ ভাল পরিমাণে ইলেক্ট্রলাইটস এবং তরল সরবরাহ করতে পারে।

৬। এনিমিয়া প্রতিরোধ করে
জাম্বুরাতে থাকা ভিটামিন-সি আয়রন শোষণে সাহায্য করে,ফলে যারা এনিমিয়া বা রক্ত স্বল্পতাতে ভুগছেন তারা প্রতিদিন অন্তত ১ কাপ জাম্বুরা খান।

৭। ইউরিক এসিডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে
যাদের দেহে উচ্চ পরিমাণে ইউরিক এসিড আছে তারা নিয়মিত জাম্বুরা খেলে ইউরিক এসিডের মাত্রা স্বাভাবিক হতে সাহায্য করে।

৮। বয়সের ছাপ দূর করে
নিয়ম করে প্রতিদিন এক গ্লাস জাম্বুরার জুস খেলে স্কিন এবং চুলের স্বাস্থ্য ভাল থাকে।জাম্বুরার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সেল ড্যামেজ প্রতিরোধ করে।ফলে,বয়সের ছাপ দূর হয়।এছাড়া,জাম্বুরাতে রয়েছে চুল থাকে সুস্থ এবং সুন্দর। নিয়মিত জাম্বুরা খাওয়া হলে অকাল বার্ধক্যের চিহ্নসমূহ হতে মুক্তি পাওয়া যায়। এছাড়া জাম্বুরায় স্পারমেডিন নামক একটি বিশেষ উপাদান রয়েছে, যা বার্ধক্য প্রতিরোধে সহায়তা করে।

৯। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়
জাম্বুরাতে উচ্চ পরিমাণে বায়োফ্লাভোনয়েডস রয়েছে যা ব্রেস্ট ক্যান্সার,কোলন ক্যান্সার এবং অগ্নাশয়ের ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।পাশাপাশি,দেহের বিভিন্ন স্থানে ক্যান্সার ছড়িয়ে যাওয়া রোধ করে। জাম্বুরা আন্ত্রিক, অগ্ন্যাশয় ও স্তন ক্যানসার প্রতিরোধ করে। এর লিমোনয়েড নামক উপকরণ ক্যানসারের জীবাণুকে ধ্বংস করে ও এর আঁশ মলাশয়ের ক্যানসার প্রতিরোধ করে।

১০। এল ডি এল কমাতে সাহায্য করে
যাদের দেহে এল ডি এল বা ব্যাড কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি তাদের জন্য জাম্বুরা ভীষণ উপকারী।জাম্বুরাতে থাকা ফাইবার কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।এছাড়া,এই ফাইবার ওজন কমাতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতেও সমান উপকারি।

১১। রুচি বাড়ায়
জাম্বুরা মূলত লো ক্যালরিসমৃদ্ধ ফল। খাবারের রুচি বাড়াতে জাম্বুরা বেশ কার্যকর। মাল্টার চেয়ে জাম্বুরায় পানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় ত্বকের জন্য এটি বেশ ভালো কাজ করে।

১২। হজম সমস্যায়
জাম্বুরায় রয়েছে প্রচুর আঁশ। এটি খাদ্যের সঠিক পরিপাকে সাহায্য করে কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়ার মতো সমস্যা দূর করে। এর আঁশ পরিপাকতন্ত্রের ক্রিয়া সচল রাখে ও সঠিক মাত্রায় পরিপাক রস নিঃসৃত করে।

১৩। রক্তচলাচল বৃদ্ধি
জাম্বুরাতে প্রচুর পটাশিয়াম রয়েছে। এটি আমাদের ধমনির আয়তন বৃদ্ধি করে রক্ত চলাচলের পথকে সুগম করে। ফলে দেহের বিভিন্ন প্রান্তে অক্সিজেন পৌঁছানো সহজ হয়, যা হৃৎপিণ্ডের ওপর চাপ কমায় এবং স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও অ্যাথেরো স্ক্লেরোসিসের আশঙ্কা হ্রাস করে।

১৪। রক্ত পরিষ্কার রাখে
জাম্বুরার ভিটামিন ‘সি’ রক্ত পরিষ্কার রাখে এবং রক্তনালির সংকোচন-প্রসারণের ক্ষমতা বাড়ায়। রক্তের লোহিত কণিকাকে টক্সিন ও অন্যান্য দূষিত পদার্থের হাত থেকে রক্ষা করে বিশুদ্ধ অক্সিজেন পরিবহনে সহায়তা করে। এটি ল্যাক্সেটিভ হিসেবে কাজ করে শরীরের দূষিত পর্দাথগুলো শরীর থেকে বের করে দিতে সহায়তা করে। ভিটামিন ‘সি’ বেশি থাকায় রক্তনালির সংকোচন-প্রসারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ডায়াবেটিস, জ্বর, নিদ্রাহীনতা, মুখের ভেতরে ঘা, পাকস্থলী ও অগ্ন্যাশয়ের বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

সতর্কতাঃ
জাম্বুরার এত সব গুনাগুন দেখে আকৃষ্ট হয়ে রাস্তার পাশে মসলা মাখানো জাম্বুরা না খাওয়াই উত্তম। আর একটি ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পটাশিয়াম থাকার কারণে কিডনি বিকলতার রোগীরা জাম্বুরা বেশি পরিমাণে খেতে পারবেন না। আবার যাঁদের রক্তচাপ কম, তাঁদেরও একটু সাবধানে খেতে হবে।

Dr. Ujjal Kumar Nath
Professor
Department of Genetics and Plant Breeding
Bangladesh Agricultural University
Mymensigh

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *