সর্বশেষঃ

পায়রা বন্দরে ভারত বাদ, চীন করবে অর্থায়ন। ৬.৪ বিলিয়ন ডলার আশা করে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ-চীন। দুটি দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক যেন দিন দিন গভীরই হয়ে চলেছে। আর সেই জাহাজেই আরেকটি পাল লাগানোর চেষ্টা বাংলাদেশের। চীন এর কাছে বাংলাদেশ চাইছে আরো ৬.৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। যার মাঝে অন্যতম হলো পায়রা সমুদ্রবন্দর ও ভোলা-বরিশাল সেতু। ভারত এর বিনিয়োগপুষ্ট পায়রা বন্দরের কাজ শেষ করার লক্ষ্যে ভারত নয়, এবার চীনের সহায়তা চায় বাংলাদেশ। আছে মোট ৯ টি প্রজেক্ট ও ৬.৪ বিলিয়নের লম্বা তালিকা। কি কি থাকছে সেখানে?

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের ‘অর্থনৈতিক সম্পর্ক’ বিভাগ ইতিমধ্য চীন এর কাছে ৯টি প্রজেক্টে অর্থায়নের জন্য চিঠি পাঠিয়েছে। যার মোট খরচ ৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উল্লেক্ষ্য যে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলারের চীনা বিনিয়োগ হচ্ছে বা হবে, যার মাঝে ২০১৬ সালে চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এর সফরেই ২৪ বিলিয়নের চুক্তি সই হয়। তার পর থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদেশি শক্তি হিসেবে সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে চীন। বাংলাদেশ ও যে তাতে এখন অবধি স্বচ্ছন্দ্য তার প্রমান বাংলাদেশের এই ‘ইচ্ছাপত্র’।

বাংলাদেশ-চীন পতাকা। ক্রেডিটঃ The AsiaN

পায়রা সমুদ্রবন্দর
পায়রা সমুদ্রবন্দরের হতে চলেছে বাংলাদেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর। আর তাতে অর্থায়ন করার কথা ছিল ভারতের। ২০১৭ সালে সই হওয়া এক চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের জন্য ভারতের “লাইন অফ ক্রেডিট-তিন” এর ৭৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থ এই পায়রা বন্দরের জন্য বরাদ্দ ছিল। কিন্তু ২০২০ এ এসে দাবার ছক অনেকটাই পালটে গেছে। পায়রা সমুদ্রবন্দরের জন্য ১.৬ বিলিয়ন ডলারের চীনা বিনিয়োগ চাইছে বাংলাদেশ।

ইতিমধ্যে ৬০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের কন্ট্রাক্ট পেয়েছে দুই চীনা প্রতিষ্ঠান “চায়না হার্বর ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পানি” এবং “চায়না স্টেট ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কনস্ট্রাকশন কর্প” । অন্যদিকে লুক্সেমবার্গে অবস্থিত “যান ডে নাল” গ্রুপ আগামী ১০ বছরের জন্য ড্রেজিং কন্ট্রাক্ট জিতে নিয়েছে। উল্লেখ্য যে ড্রেজিং এর খরচ হিসেবে ধরা হয়েছে ১ বিলিয়ন ডলার এবং সরাতে হবে ১০০ মিলিয়ন কিউবিক মিটারের বেশি মাটি ও অন্যান্য বস্তু। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে যেই কয়টি প্রজেক্টের নতুন কাজ শুরু হতে যাচ্ছে তার মাঝে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলা চলে। ২০১৬ সালে পায়রা বন্দরের প্রথম পর্যায়ের আংশিক কাজ সম্পন্ন হলেও এবার চীন এর অর্থায়নে প্রথম ফেজের পুরো কাজ শেষ হবে আশা করা যায়। ধারনা করা হচ্ছে শেষ অবধি পায়রা সমুদ্র বন্দরের ব্যায় গিয়ে দাঁড়াবে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

পায়রা সমুদ্রবন্দর। ক্রেডিটঃ ঢাকা ট্রিবিউন

ভোলা-বরিশাল সেতু
বাংলাদেশের যেকোনো অর্থনৈতিক কার্যক্রম থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ জেলা ‘ভোলা’। একটি সেতুর অভাবে ভোলার প্রাকৃতিক গ্যাস ভান্ডার ও সরবরাহ করা যাচ্ছে না। আর তাই বাংলাদেশ সরকার এ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সেতুটি করার সিধান্ত নিয়েছে। ১০ কিলোমিটার লম্বা এই সেতুটি হবে বরিশাল ও ভোলা জেলার মাঝে। এই সেতু হবে ভোলার ভেদুরিয়া ফেরিঘাট এর শখানেক মিটার নিচ থেকে বরিশালের লাহারহাট ফেরিঘাটের মাঝে।

১০ কিলোমিটার লম্বা সেতুটি অতিক্রম করবে দুটি নদী এবং এর নিচে থাকবে ৩ কিলোমিটার শ্রীপুর চর। এর জন্য বাংলাদেশ চীন এর কাছ থেকে আশা করে ১.২ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন। উলেক্ষ্য যে এই সেতুটি হলে এটি হবে বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। বর্তমানে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.৩ কিলোমিটার।

পদ্মা সেতু। ক্রেডিটঃ দা ডেইলি স্টার

বিদ্যুৎ খাত
বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে যেসব খাতে বিনিয়োগ আশা করে এবার তার মাঝে বিদ্যুৎ খাত বেশ প্রাধান্য পেয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের জন্য বাংলাদেশ চীন এর কাছে চাইছে ৮৫০ মিলিয়ন ডলার। Expansion of Strengthening of Power System Network under DPDC area (PGCB part)-প্রজেক্টের আওতায় বিদ্যুৎ খাতকে আরো মজবুত ও বর্ধিত করার লক্ষ্যে ২০১৭ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে। ২০১৮ সালে অনুমতি পাওয়া এই প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য রাজধানি ঢাকা ও তার আশে পাশের বেড়ে চলা বিদ্যুৎ চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে চলা। এই প্রজেক্টের ভেতরে আছে ৪০০/২৩০ কিলোভোল্টের নতুন জিআইএস সাবস্টেশন, ২৩০/১৩২ কিলোভোল্টের নতুন ইনডোর জিআইএস সাবস্টেশন, ৪০০, ২৩০, ১৩২ কিলোভোল্টের জন্য যথাক্রমে ৩৩০, ১১১ ও ৮.৮ Ckt. কিলোমিটার লাইন। এছাড়াও আছে ২৩০ কিলোভোল্টের ৯৬ Ckt. কিমি. লম্বা ইউজি কেবল।

বৈদ্যুতিক পাওয়ার লাইন। ক্রেডিটঃ পাওয়ার টেকনোলজি

আরো যেসব প্রকল্প রয়েছে তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো তিস্তার নদীশাসন। নদীশাসন প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ চীন হতে আশা করছে ৮৫৩ মিলিয়ন ডলার।

আরেকটি প্রজেক্ট হলো ‘শেখ হাসিনা ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলোজি ও হাই-টেক পার্ক’ এই হাই টেক পার্কটি ইতিমধ্যে ৫১টি কম্পানির মাঝে বরাদ্দ হয়েছে।

এছাড়াও অন্যান্য প্রজেক্টগুলি হলো, বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, অয়েল ট্যাংকার সংগ্রহ, ঢাকার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নতীকরণ, এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোটখাটো হাইটেক ব্রীজ নির্মাণ। আর এই সব কয়টি প্রজেক্ট মিলিয়েই ৬.৪ বিলিয়নের একটি ‘উইশলিস্ট’ পাঠিয়েছে বাংলাদেশ।

কিন্তু আদৌ কি চীন সরকার এই বিনিয়োগ করবে?

এই প্রশ্নের উত্তরে বলতেই হয়, গত বছরই চীন বাংলাদেশকে এক অনুরোধ করে। তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ইতিমধ্যে যেসকল প্রজেক্ট-মেগা প্রজেক্ট চলছে সেগুলোর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন বাংলাদেশ নতুন করে কোন অর্থায়নের দাবি না করে। কিন্তু এ বছরই আবার ৬.২ বিলিয়নের বিনিয়োগ চাইছে বাংলাদেশ।

তবে কথাটি শুনে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ চীনের কাছে শুধু বিনিয়োগ চায় নি বরং কিছু প্রজেক্ট থেকে চীনের অর্থায়ন সরিয়েও দিয়েছে। প্রায় ৩.২ বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট এ চীনকে লাগবে না বাংলাদেশের, এমনটাই সিধান্ত হয়েছে। কারণ আর কিছু নয়, সেসকল প্রজেক্টের জন্য অন্য দাতা পেয়েছে বাংলাদেশ। তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ঢাকা-সিলেট চার লেন হাইওয়ে’ প্রজেক্ট। এই প্রজেক্টে অর্থায়ন করছে এডিবি তথা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। অর্থাৎ বাংলাদেশ এসকল প্রজেক্টে চীনের অর্থায়ন প্রত্যাহার করে আবার সেই অর্থই অন্য প্রজেক্টে ব্যয় করতে চাচ্ছে। যাকে একটি বেশ ভাল চালই বলা চলে। আর এ বিষয়ে প্রস্তাব গতমাসেই ‘ইনভেস্টমেন্ট কোঅপারেশন ওয়ার্কিং গ্রুপ’ এর মিটিং তুলেছে বাংলাদেশ।

পরিশেষে এইটুকুই বলা যায়, বরাবরের মতই বাংলাদেশ-চীনের অর্থনৈতিক গাঁটছড়া এখনো অটুট রয়েছে। এখন চীন বাংলাদেশের এবারের প্রস্তাবে সায় দেয় কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।