সর্বশেষঃ

সুয়েজ খালের বিকল্প হতে চলেছে ইরানের চাবাহার বন্দর

বর্তমান বিশ্বের একটি দেশ আরেকটি দেশের সঙ্গে যতটা সামরিক যুদ্ধে জড়াচ্ছে তার চেয়ে বেশি জড়িয়ে পড়ছে বাণিজ্যিক যুদ্ধে। সামরাস্ত্রহীন এই যুদ্ধে বুদ্ধি, কৌশল আর সামর্থ্যের বিচারেই নির্ধারণ হচ্ছে জয় পরাজয়। সে যুদ্ধে এগিয়ে থাকার জন্য খাল কেটে কুমির নয়, জাহাজ এনেছিলো মিশর। ১৮৬৯ সালে নৌ-চলাচলের জন্য খুলে দেয়া দেয়া হয় কৃত্তিমভাবে খনন করা সুয়েজ খাল। এই খালের আয় দিয়েই পূরণ হয় মিশরের জাতীয় বাজেটের প্রায় ৮০ শতাংশ।
বিশ্বরাজনীতিতে ইরানের অর্থনীতি এবং সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি-মার্কিন জোটের অন্যতম মিত্র মিশরের অর্থনীতিতে বড় আঘাত হানতে চললো মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। ইরান উদ্যোগ নিয়েছে সুয়েজ খালের বিকল্প হিসেবে তাদের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় চবাহার সমুদ্রবন্দর। এতে ইরান যেমন লাভবান হবে তেমনি একটি বড় আঘাত আসবে মার্কিন-সৌদি জোটের বড় মিত্র দেশ মিশনের অর্থনীতিতে। এই উদ্যোগের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে মিশরের সমুদ্রসীমায় বড় বিনিয়োগ করা আরব-আমিরাত ও সৌদি আরব।
সুয়েজ খাল খনন করার আগ পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জাহাজগুলোকে ভূমধ্যসাগর থেকে পুরো আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ উত্তমাশা অন্তরীপ পাড়ি দিয়ে আরব সাগর হয়ে ভারত এবং প্রশান্ত মহাসাগরে যেতে হতো। এই যাত্রা যে শুধু সময়সাপেক্ষ ছিল, তা-ই নয়, ছিল বিপজ্জনকও। আফ্রিকা মহাদেশ পাড়ি দেওয়ার সময় প্রায়ই ঝড়ের কবলে পড়ে জাহাজডুবির ঘটনা ঘটত।
সুয়েজ অঞ্চলে ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরকে যুক্ত করে ১০০ মাইল দীর্ঘ একটি খাল খনন করা হয়। ১৮৫৬ সালে গঠিত হয় সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানি। প্রায় তিন বছর পর, ১৮৫৯ সালের এপ্রিল মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় খালটির খননকাজ। ১৮৬৯ সালের ১৭ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে সুয়েজ খাল।
ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগর সংযুক্ত এবং এশিয়া-আফ্রিকা বিচ্ছিন্ন করা সুয়েজ খাল মূলত সামুদ্রিক বাণিজ্যের চেহারাই পাল্টে দিয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৭০টি আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল করে সুয়েজ খালে। এতে পণ্য পরিবহন করা হয় তিন থেকে পাঁচ মিলিয়ন টন। বছরে প্রায় ২৫ হাজার জাহাজ সুয়েজ খাল ব্যবহার করে। এর বিনিময়ে মিসর ৪৭৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রাজস্ব উপার্জন করে।
সুয়েজ খারের বিকল্প হিসেবে এখন আরও নিরাপদ ও সহজ পথ তৈরিতে মনোযোগী হয়েছে ইরান। ইরানে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় চবাহার সমুদ্রবন্দর শিগগিরই ইউরোপের সঙ্গে এশিয়ার বাণিজ্যিক রুট হিসেবে সুয়েজ খালের প্রয়োজনীয়তা ম্লান করে দেবে বলে মন্তব্য করেছে তেহরান। ইরানের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর- চবাহারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রহিম কুর্দির উদ্ধৃতি দিয়ে রোববার খবর প্রকাশ করে ইরানী সংবাদ মাধ্যম রেডিও তেহরান।
কুর্দি বলেন, ভারত থেকে ব্যবসায়িক পণ্য চবাহার বন্দর হয়ে জার্মানিতে পৌঁছাতে সময় লাগে ১৪ থেকে ১৬ দিন। অথচ সুয়েজ খাল হয়ে বড় জাহাজে করে এই পণ্য ইউরোপে পৌঁছাতে সময় লাগে ৩৮ দিন।
চবাহার সমুদ্রবন্দরের ব্যাপক সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে এটির উন্নয়নে ইরান বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। সেইসঙ্গে বিশ্বের যেকোনো দেশ ও কোম্পানিকে তাদের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য এই বন্দরে পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ অবারিত করে দিয়েছে তেহরান।
ইরানের পর এখন পর্যন্ত ভারত এই বন্দরে সবচেয়ে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। আফগানিস্তানসহ মধ্য এশিয়ার ভূমিবেষ্টিত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন করতে এই সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে চায় ভারত।
এদিকে ইয়োরোপের দেশগুলো আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের পক্ষ ত্যাগ করার শুরু করেছে। যার প্রভাব পড়ছে অর্থনৈতিক যুদ্ধেও। ইয়োরোপের সঙ্গে এশিয়ার যোগাযোগ আরো সহজ করতে চাবাহার বন্দর ক্রমেই নিরাপদ ও সহজ হয়ে উঠবে। কারণ সুয়েজ খাল আর রাজনৈতিক কারণে ইয়োরোপের জন্য নিরাপদ নাও হতে পারে। অন্যদিকে খরচ এবং সময় যখন অর্ধেকে নেমে আসবে সুয়েজ খালের তুলনায় চাবাহার বন্দর তখন ব্যবসায়ীরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ইরানকেই রুট হিসেবে ব্যবহার করবে যেটি ইরানের অর্থনীতিতে যেমন নতুন মাত্রা যোগ করবে তেমনি বিশ্ব রাজনৈতিক অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনবে বলে মত বিশ্লেষকদের।