সর্বশেষঃ

১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ (১ম পর্ব)

সত্তরের দশকের প্রধান বৈশিষ্ট্য, দুই বিশ্ব-পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধের স্নায়বিক চাপের ভয়াবহ ঊর্ধ্বগতি। এই দশকের শুরুতেই, ১৯৬২ সালে কিউবান মিসাইল সংকট পৃথিবীকে পারমাণবিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। ঠিক এই সময় যখন গোটা বিশ্বের নজর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাত্র ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আটলান্টিক মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র কিউবার দিকে, তখন অনেকটা সকলের অগোচরেই এশিয়ার দুই উদীয়মান শক্তি ভারত ও চীন লিপ্ত হয় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে, যা আপাতদৃষ্টিতে এক মাস স্থায়ী হলেও সুদূরপসারী প্রভাব ফেলে দক্ষিণ এশীয় ভূ-রাজনীতিতে।

হাজার বছরের পুরনো দুই সভ্যতা ভারত ও চীন দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক দাসত্বের পর যথাক্রমে ১৯৪৭ ও ১৯৪৯ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। প্রথম দিকে, দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক যথেষ্ট উষ্ণ ছিল, যার পিছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর। কিন্তু বিস্তৃত অমীমাংসিত সীমান্ত এবং চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী মনোভাব আন্তরিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পথে বরাবরই বাধা হয়ে দাঁড়ায় যা শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় সশস্ত্র সংঘর্ষে। ১৯৬২ সালে চীনের আকস্মিক ভারত আক্রমণের পিছনে প্রধানত তিনটি কারণ ছিলঃ

উপমহাদেশের ম্যাপ এ সীমান্ত

তিব্বত সঙ্কট:
১৯৫০ সালের অক্টোবরে চ্যাম্ব্ড সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে চীন জোরপূর্বক তিব্বতকে নিজের অন্তর্ভুক্ত করে এবং আধিপত্য জোরদার করার লক্ষ্যে ব্যাপক নির্মাণকাজ হাতে নেয়। প্রাথমিকভাবে ভারতের প্রতিক্রিয়া লিখিত প্রতিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যেখানে ভারত চীনকে কূট-নৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য আহ্বান জানায়। ১৯৫৯ সালের মার্চে, তিব্বতের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা চতুর্দশ দালাই লামা চৈনিক শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর ভারতে পলায়ন করেন এবং সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন, যা চীনের শাসনকর্তাদের বিশেষ করে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান মাও জেডংকে অতিশয় ক্রুদ্ধ করে তোলে।

আকসাই চিন:
তিব্বত ও চীনের উত্তর-পশ্চিমের প্রদেশ জিনজিয়াং-এর মাঝে অবস্থিত আকসাই চিন, যা মূলত এক সুউচ্চ মরুভূমি। ১৮৫৬ সালে প্রস্তাবিত জনসন লাইন অনুসারে আকসাই চিন ভারতের জম্মু-কাশ্মীর প্রদেশের অন্তর্গত লাদাখের একটি অংশ হবার কথা। কিন্তু চীন জনসন লাইনকে কখনো স্বীকৃতি দেয়নি, স্বভাবতই আকসাই চিনকেও ভারতের অংশ হিসেবে মেনে নেয়নি। তিব্বত অধিগ্রহনের পর ১৯৫১ সালে চীন তৎকালীন ভারত নিয়ন্ত্রিত আকসাই চিনের মধ্য দিয়ে তিব্বত ও জিনজিয়াংকে সংযোগকারী প্রায় ২০৮৬ কি:মি: দীর্ঘ ‘চায়না ন্যাশনাল হাইওয়ে ২১৯’ নির্মান শুরু করে। রাস্তাটি যে ভারতের সীমানা লঙ্ঘন করে নির্মিত হচ্ছে তা ভারতীয় সরকারের দৃষ্টিগোচর হয় ১৯৫৭ সালে নির্মানকাজ সম্পন্ন হবার পর, কেননা ইতোমধ্যে বহুবার চাইনিজ কর্তৃপক্ষ ভারতকে আশ্বস্ত করেছিল যে সীমান্তবর্তী এলাকায় তাদের কর্মকাণ্ড ভারতীয় সীমানা লঙ্ঘন করবে না।

Map of Arunachal Pradesh, one of the disputed area between China and India.

অরুণাচল প্রদেশ:
১৯১৪ সালে সিমলা সম্মেলনে প্রস্তাবিত ম্যাকমাহন লাইন অরুণাচল প্রদেশ তথা নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এরিয়াকে (নেফা) ভারতের অন্তর্ভূক্ত করে। ম্যাকমাহন লাইনকেও অস্বীকৃতি জানানোর ফলস্বরূপ চীন আরুণাচল প্রদেশকে নিজের অংশ হিসেবে মনে করে । ১৯৫৯ সালের আগে খুব একটা জোরালো দাবি না তুললেও দালাই লামার ভারতে আশ্রয় লাভের পর ক্ষুব্ধ চীন এক প্ররোচনামূলক পদক্ষেপে জাতীয় মানচিত্রে আরুণাচল প্রদেশ ও নেফাকে অন্তর্ভূক্ত করে।

তিব্বত অধিগ্রহন এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় চীনের কর্মতৎপরতায় ভারত-সরকারের টনক নড়ে। তারা কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়, যার ফলস্বরূপ ১৯৫৪ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক আলোচনা সংগঠিত হয়। আলোচনায় আকসাই চিন ও নেফাকে অন্তর্ভূক্ত করে একটি ভারতীয় মানচিত্র প্রস্তাবিত হয়, যা সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত হয়। এই সময়েই নেহেরু “হিন্দি-চীনি ভাই-ভাই” স্লোগান প্রচার করেন। কিন্তু সীমান্তে চীনের কথা ও কাজের মিল না থাকায় ভারতীয়দের মনে চীনের অভিসন্ধি নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৫৭ সাল নাগাদ ভারত স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করে যে সীমান্ত নিয়ে চীনের আশ্বাস প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। এদিকে দালাই লামাকে আশ্রয় দানের পর থেকে তিব্বত-সংলগ্ন সীমান্তে চৈনিক ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে ঘনঘন সংঘর্ষ হতে থাকে, যার একটিতে ভারতের নয়জন সীমান্তরক্ষী নিহত হয়। চীনের সাথে অধোগামী সম্পর্ক এবং সশস্ত্র সংঘর্ষের অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি ভারতকে বাধ্য করে চীনের বিরুদ্ধে ব্যাপক কূট-নৈতিক তৎপরতা হাতে নিতে, যার মূল লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে একঘরে হয়ে থাকা চীনের উপর সীমান্ত-সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য চাপ বাড়ানো এবং সম্ভাব্য সংঘর্ষের ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মিত্র হিসেবে পাশে পাওয়া।

অপরদিকে চীন অনেকদিন ধরেই সন্দেহ করছিল তিব্বতে অস্থিতিশীলতার পিছনে ভারতের মদদ আছে। ১৯৫৯ সালে ভারত দালাই লামাকে আশ্রয় দিলে এই সন্দেহ নিশ্চয়তায় পরিণত হয়। একই সালে সীমান্তে চীনকে মোকাবিলার উদ্দেশ্যে ভারত ‘সম্মুখ নীতি’ গ্রহন করে। এই নীতির অংশ হিসাবে ভারত বিতর্কিত সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সেনা মোতায়েন এবং বিভিন্ন স্থানে চৌকি নির্মান শুরু করে, যার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছিল ম্যাকমাহন লাইনের উত্তরে অর্থাৎ চীন নিয়ন্ত্রত এলাকায়।

ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের ধারণা ছিল চীনের সাথে টানাপোড়েন সীমান্তে ও কূট-নৈতিক মহলে অকিঞ্চিৎকর বিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং সম্মুখ-সমর পর্যন্ত কখনোই গড়াবে না। কারণ ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের প্রতি মৌখিক সমর্থন জানিয়েছিল। তাছাড়া চীন এসময় তাইওয়ানের জাতীয়তাবাদী সামরিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিচলিত ছিল। ভারতের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এরূপ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভারতীয় মূল ভূ-খণ্ডে আক্রমণের মত দু:সাহসী সিদ্ধান্ত চীন নেবে না আর নিলেও ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মত শক্তিশালী মিত্রকে পাশে পাবে।

কিন্তু চীনের শাসকগোষ্ঠী তিব্বতের ব্যাপারে কোন আপস করতে রাজি ছিল না এবং তিব্বতের উপর দৃঢ় আধিপত্যের জন্য আকসাই চিন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্ত নিয়ে ভারতের সকল তৎপরতা তাদের কাছে মূঢ় স্পর্ধা হিসেবে বিবেচিত হয় এবং ভারতকে সমীচীন জবাব দেওয়া হয়ে ওঠে নিছক সময় ও সুযোগের ব্যাপার।

চীন কয়েক মাস ধরে ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। ১৯৬২ সালের ২৩শে জুন, আমেরিকার মধ্যস্থতায় চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে উত্তেজনা সাময়িক ভাবে প্রশমিত হলে চীন বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম তিব্বতে ভারতীয় সীমান্ত বরাবর মোতায়েন করে। এমনকি, চীন আসন্ন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে কলকাতা বন্দর ব্যাবহার করে বিপুল পরিমাণে বেসামরিক রসদ তীব্বতে প্রেরণ করে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে ভারতীয় নেতৃত্ব কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি, সোজাসাপটা ভাষায় চীন ভারতের নাকের ডগায় বসে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। এখন শুধু মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষা।

অতঃপর, ১৯৬২ সালের ১৬ই অক্টোবর শুরু হয় ‌’কিউবান মিসাইল সংকট’, সম্ভবত প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরে চলা শীতল যুদ্ধের সবচেয়ে বিপজ্জনক ঘটনা যেখানে এক পরাশক্তি সরাসরি অবস্থান নেয় অপর পরাশক্তির বিপরীতে এবং মানবসভ্যতা অবস্থান নেয় পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞের বিপরীতে। গণচীন ঠিক এই রকম একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে দূর প্রাচ্যে ঘটে যাওয়া কোন যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকবে না, কেননা সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধের তুলনায় চীন-ভারত যুদ্ধ ছিল নিতান্তই নগন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *