সর্বশেষঃ

করোনায় আক্রান্ত বিশিষ্টজনরা

করোনায় বিশ্বব্যাপী গতকাল পর্যন্ত ৫৮ লাখ ৭ হাজার আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে ৩ লাখ ৫৮ হাজার। এ সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশেও করোনা থাবা বিস্তার করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ৪০ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ৫৫৯ জন। তবে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা এর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি।

বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু ঘটনা নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের মধ্যেই একরকম সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ঈদের ছুটিতে এবং ছুটি শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে থেকে উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষও করোনায় আক্রান্তের খবর এসেছে। এই সময়ের আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির পাশাপাশি বিশিষ্ট ব্যক্তি (ভিআইপি), সাবেক এমপি, শিল্পপতি, বড় ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, শিক্ষক, গুণী মানুষ, খ্যাতনামা ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, পুলিশ, আমলা, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্মী, সাংবাদিক, রাজনীতিক, প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান পদস্থ কর্মকর্তারাও করোনায় ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মারাও যাচ্ছেন।

ঈদের ছুটিতে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এতে করোনা আতঙ্ক এখন সব শ্রেণি ও পেশার মধ্যে সংক্রমিত হয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে পুলিশ। ইতোমধ্যে ১৫ জন পুলিশ সদস্য মারা গেছেন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে। অন্যদিকে পুলিশে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪ হাজার।

গত ১৪ মে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান জাতীয় অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। ওইদিন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর নমুনা পরীক্ষায় আনিসুজ্জামানের করোনা পজিটিভ আসে। ঈদের আগের দিন সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ মকবুল হোসেন। তার স্ত্রী মোনা হোসেনও করোনা আক্রান্ত হন। তিনি বর্তমানে চিকিৎসাধীন।

করোনা আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম ব্যবস্থাপক আশরাফ আলী (৬০) গত বুধবার রাতে রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতালে মারা যান। তিনিই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম কর্মকর্তা, যিনি করোনায় মারা গেলেন। এর আগে দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাত কর্মকর্তা মারা যান। দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ জন ব্যাংকার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ৩০ কর্মকর্তা।

এ ছাড়া করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন দেশের অন্যতম শিল্পপতি এস আলম গ্রুপ ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের পরিচালক মোরশেদ আলম (৬৮)। মোরশেদ আলম গত ২২ মে রাত পৌনে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গত ১৭ মে মোরশেদ আলমসহ একই পরিবারের ছয়জনের শরীরে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়।

ঢাকার সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুর গত ২৫ মে সোমবার রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নিলুফার মঞ্জুরের বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। যিনি গত সাড়ে চার দশকে অগণিত শিক্ষার্থীকে দেখিয়ে গেছেন জীবন পথের দিশা। বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী তার স্বামী। এপেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মঞ্জুর এলাহী নিজেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। তিনি বর্তমানে বাসায় চিকিৎসাধীন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

গত ৭ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. নাজমুল করিম চৌধুরী (৭০) করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিলেন। নাজমুল করিম গত ৫ মে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

গত ১০ মে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব) আনোয়ারুল কবির তালুকদার। রাজধানীর সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

সদ্য অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়া অতিরিক্ত সচিব তৌফিকুল আলম গত ২২ মে মারা যান। তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বিসিএস অষ্টম ব্যাচের (১৯৮৬) এ কর্মকর্তা সর্বশেষ তথ্য কমিশনের সচিব ছিলেন। গত ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি পিআরএলে যান। গতকাল বৃহস্পতিবার করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সাবেক যুগ্ম সচিব, মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ইসহাক ভূইয়া (৭৫)। ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে।

গত ৬ এপ্রিল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক জালাল সাইফুর রহমান মারা যান। তিনি রাজধানীর কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। জালাল সাইফুর রহমান বিসিএস ২২তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন।

৩ মে দেশের অন্যতম হেমাটোলজিস্ট এবং ল্যাবরেটরি মেডিসিন স্পেশালিস্ট অধ্যাপক কর্নেল (অব) মো. মনিরুজ্জামান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারানো দেশের দ্বিতীয় চিকিৎসক তিনি। ড. মো. মনিরুজ্জামান আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চিফ হেমাটোলজিস্ট ছিলেন। এর আগে গত ১৫ এপ্রিল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন। তিনি করোনায় মারা যাওয়া প্রথম চিকিৎসক। সিলেটে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ টিমের সদস্য ছিলেন ডা. মঈন।

১৩ মে মধ্যরাতে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মেজর (অব) আবুল মোকারিম মো. মহসিন উদ্দিন মারা যান। মৃত্যুর ১০ দিন আগে অধ্যাপক আবুল মোকারিমের নমুনা পরীক্ষায় করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। শুরুতে ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকলেও অবস্থার অবনতি হলে আইসিইউ সাপোর্টের পরে তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়েছিল।

মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও মিনিবাস মালিক সমিতির চেয়ারম্যান সৈয়দ মফচ্ছিল আলী গত ১৩ এপ্রিল রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যান। তিনি জ্বর ও সর্দি-কাশি নিয়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। মৃত্যুর পর তার নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হলে রিপোর্ট পজিটিভ আসে।

গত ২৮ এপ্রিল রাতে দৈনিক সময়ের আলোর নগর সম্পাদক হুমায়ুন কবির খোকন ঢাকার রিজেন্ট হাসপাতালে মারা যান। তিনি বেশ কিছু দিন ধরেই দাঁতের ব্যথায় ভুগছিলেন, সঙ্গে ছিল জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট। অবস্থা খারাপ হলে তাকে রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সেখানে মারা যান। পরবর্তী সময়ে তার নমুনা সংগ্রহ করা হলে তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন বলে জানা যায়। সাংবাদিক খোকনের স্ত্রীও করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি এখন সুস্থ।

গত ৫ মে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা যান দৈনিক সময়ের আলোর আরেক সাংবাদিক মাহমুদুল হাকিম অপু। তিনি পত্রিকাটিতে সিনিয়র সাব-এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

এ ছাড়া করোনা আক্রান্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন- গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি, মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কুতুবউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী, বিএসএমএমইউ হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, প্রবীণ ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুর রেজাক খান এবং তার স্ত্রী মমতাজ বেগম, সিলেটের সাবেক মেয়র ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের স্ত্রী ও মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী আসমা কামরান প্রমুখ। আক্রান্ত এসব বিশিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে বেশিরভাগই ইতোমধ্যে সুস্থ হয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *