সর্বশেষঃ

চাহাবার বন্দর ভারতের জন্য নতুন দুশ্চিন্তা

চাহাবার বন্দর ভারতের জন্য নতুন দুশ্চিন্তা
ভারতকে চাহাবার বন্দর রেল প্রকল্প থেকে বাদ দিয়েছে ইরান। প্রাথমিক অবস্থায় তেহরানের এই সিদ্ধান্ত ভারতের চোপেটাঘাত বলা যায়। এটি ভারতের মার্কিন প্রীতিরই ফল বলে মানছেন অনেকে। যদিও ইরান বলছে অর্থ ছাড়দিতে দেরি করছে ভারত। তাই নিজেদের অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায় তারা।
২০১৬ সালের মে মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তেহরান সফরে যান। ওই সময় ইরানের চাবাহার সমুদ্রবন্দর থেকে আফগানিস্তান সীমান্ত লাগোয়া ইরানি শহর জাহেদান পর্যন্ত ৬২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন নির্মাণের জন্য ভারত, ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি ত্রিদেশীয় চুক্তি হয়। চুক্তিতে সই করেন মোদি, ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ও আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের একটি বিকল্প বাণিজ্যপথ গড়ে তোলাই ছিল এই চুক্তির মূল লক্ষ্য।
ইরানের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ভারতের কোনো সহায়তা ছাড়া একাই ওই প্রকল্প পরিচালনা করা হবে। কাজ শেষ হবে ২০২২ সালের মধ্যে। প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ৪০ কোটি মার্কিন ডলার দেবে ইরানের জাতীয় উন্নয়ন তহবিল।

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, করোনাভাইরাস ও টিকে থাকার লড়াইয়ে বিপুল পরিমাণ সামরিক ব্যায়ের কারণে ভঙ্গুর দশা ইরানের অর্থনীতির। এমন পরিস্থিতিতে দেশটি ৪০ কোটি ডলার ব্যয় করতে চায় কারো সহায়তা ছাড়াই। এটি ভাবিয়ে তুলেছে গোটা উপমহাদেশকে। তাহলে এই প্রকল্পের মধ্যে কি ভূরাজনৈতিক চিত্র বদলে দেয়ার মতো কোনো কৌশল লুকায়িত রয়েছে কিনা যেটি ভারত বুঝতে পারেনি।

প্রকল্প থেকে ভারতকে বাদ দেওয়ার দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমটা হচ্ছে, গত সপ্তাহে চীনের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদের হাজার হাজার কোটি মার্কিন ডলারের কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে তেহরান। দ্বিতীয়টা হচ্ছে, চীনের সঙ্গে উত্তেজনা বেড়েছে ভারতের। আবার ইরানের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করতে দিল্লির ওপর বহু দিন ধরেই চাপ বাড়াচ্ছিল ওয়াশিংটন। এসব মিলিয়ে সিদ্ধান্তটা আসতে পারে।
তাই শত্রুর বন্ধু শত্রুতে রূপান্তর হলো ভারত আর ইরানের ক্ষেত্রে। যদিও বিশ্বরাজনীতিতে এমন নজির খুব একটা দেখা যায় না। তবে নরেন্দ্র মোদির অতিরিক্ত মার্কিন প্রীতিই এমন পরিণতি ডেকে এনেছে দেশটির জন্য। এতে অবশ্য ইরানের জন্য অন্য বিকল্পও ছিলো না। কারণ আগামী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের উপর আরো বড় বড় নিষেধাজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে খুব বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ইরানের জন্য বড় ক্ষতি বয়ে আনবে। তাই হয়তো আগেই সতর্ক তেহরান।
আবার ইরান প্রশ্নে আমেরিকার রণহুঙ্কারের সামনে অতিরিক্ত তেহরান-প্রেম ভারতের জন্য মার্কিন বন্ধুত্ব হারিয়ে চীনের সামনে একা হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে। তাই চীন এবং ইরান ইস্যুতে ভারতের পররাষ্টট্রনীতি ঢেলে সাজানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন কূটনৈতিকরা। অন্যদিকে ইউরোপ অ্যামেরিকার দেশগুলো যেভাবে এক হয়ে কাজ করে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সেভাবে কাজ করার নজির নেই। তাই এখনই সময় প্রতিবেশিদের সঙ্গে ভালো আচরণ করার। অন্যথায় ভারতের সামনে বড় বিপদ আসতে পারে।
এদিকে ইরান-চীনের ২৫ বছরের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আর্থিক মূল্য প্রায় ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ইরানের মূল পেট্রোলিয়াম ক্ষেত্র, ব্যাঙ্কিং, টেলিকম, রেল, মেট্রো, বন্দর, বিমানবন্দর-সহ বিভিন্ন পরিকাঠামো ক্ষেত্রে এ বার হইহই করে ঢুকে যাবে চিন। বিনিময়ে চিন এবং ইউরোপের মধ্যে সংযোগের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে ইরান। হয়ে উঠবে চিনের মহাযোগাযোগ প্রকল্প ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’-এর অন্যতম অংশীদারও। পাশাপাশি যৌথ সামরিক মহড়া, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র উৎপাদনেও সামিল হবে চিন এবং ইরান। এর কোনওটাই সাউথ ব্লকের জন্য ভাল খবর নয়।
ইরানকে কাজে লাগিয়ে মধ্য এশিয়া তথা পূর্ব ইউরোপে পৌঁছনোর ভারতীয় পরিকল্পা ক্রমেই ভেস্তে যেতে বসেছে। অন্যদিকে ইরানের বন্দর এবং রেলে চীনের বিনিয়োগের ফলে ভারতীয় পণ্য মধ্য এশিয়ার পৌঁছনোর প্রশ্নে সংশয় তৈরি হবে। চাবাহার বন্দরের পরিচালনভার চীন না পেলেও গোটা প্রকল্প ঘিরে যাবতীয় পরিকাঠামো তাদের হাতে চলে গেলে এই বন্দরে এত দিন ধরে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ ভারতের জন্য অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে বলেও আশঙ্কা দিল্লীর জন্য।