সর্বশেষঃ

সাহান আরা বেগম একজন মহিয়সী নারী ছিলেন

বার্তাকক্ষ : সাহান আরা বেগম বরিশাল শহরের কাউনিয়া প্রথম গলীর মুসলিম সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে ১৯৪৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী জন্ম গ্রহন করেন। জন্মের পর থেকে তিনি বরিশাল শহরের বুকেই বড় হয়ে ওঠেন। ফলে বরিশালবাসীর সাথে তার নিবির এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি স্কুল জীবন শেষে বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হন। সেসময় তিনি কলেজে সাধারন শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অধীকার আদায়ে শিক্ষার্থীদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। ফলে সমস্ত কলেজে তিনি শিক্ষার্থীদের একজন প্রিয় মানুষে পরিনত হন। পরবর্তিতে শিক্ষার্থীদের দাবীর মুখে তিনি ১৯৬৬ সালে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ভিপি নির্বাচিত হন। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই তিনি সাফল্যের দেখা পান।

এরপর ১৯৬৭ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ভাগ্নে ও আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ছেলে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ’র সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার নিজের রাজনীতি ও সেরনিয়াবাত পরিবারের রাজনীতি দুই মিলে দেশ স্বাধীনের পূর্ব থেকে নানান চরাই উৎরাইর মধ্য দিয়ে তার নতুন বৈবাহিক জীবন শুরু হয়। দেশের প্রয়োজনে, দেশের মানুষের প্রয়োজনে তিনি কখনো নিজের কথা ভাবেননি, সর্বদা মানুষের জন্য কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালে দেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি মুজিব বাহীনির সকল কার্যক্রমে সরাসরি অংশগ্রহন করেন। অংশ নেন বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে।

সাহান আরা বেগম রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে সরাসরি অংশগ্রহন করেন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের কারনে দিনের বেশীর ভাগ সময়েই তাকে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়েছে। কিন্তু শত ব্যস্ততাও তাকে স্বামী, সন্তান বা শশুর,শাশুরীর প্রতি সঠিক দায়িত্বপালনে বাধা দিতে পারেনি। তিনি যেভাবে শশুর, শাশুরীর প্রতি যত্নবান ছিলেন ঠিক তেমনি স্বামী, সন্তানদের কখনো তার অভাব অনুভব করতে দেননি। কিন্তু ১৯৭৫ সালে সমস্ত বাংলাদেশের মত তার জীবনেও অন্ধকার নেমে আসে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মনির বাড়ীতেও হামলা চালায়। সেই হামলায় অন্যদের সাথে সাহান আরা বেগমের চার বছরের শিশু পুত্র সুকান্ত বাবু নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের স্বীকার হয়। সেদিন তিনি নিজেও বুলেটে আঘাতপ্রাপ্ত হন। কিন্তু বুলেটে আঘাত প্রাপ্ত হয়েও আরেক শিশু পুত্র আজকের বরিশাল সিটি কর্পোরেশন মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে বুকে জড়িয়ে কোনভাবে প্রানে বেঁচে যান। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট কালরাতের একজন প্রতক্ষদর্শী। সেই ১৯৭৫ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৫ বছর ঘাতকের বুলেটের ক্ষত নিয়ে বেঁচে ছিলেন শহীদ জননী, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহান আরা বেগম।

১৯৭৫ পরবর্তি সময়ে তাকে পার করতে হয়েছে আরো ট্রাজেডিময় জীবন। তৎকালনি রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারনে তার ছোট ছোট সন্তান নিয়ে তাকে ঘর ছাড়তে হয়েছে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে পার করতে হয়েছে জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত । স্বামী, সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়েছে। কিন্তু জননী সাহসিকা সাহান আরা বেগম তার দৃঢ়চেতা মনোবলের কারনে বড় বড় বিপর্যয়ের সময়ে ভেঙে পরেননি। তিনি সকল বিপর্যয় শক্ত হাতে সামাল দিয়েছেন। অন্যদিকে ১৯৭৫ পরবর্তি সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দলকে পুনঃগঠন করার জন্যে তিনি একজন মহিয়সী নারীর ভূমিকা পালন করেন। ফলে আতংকময় জীবনে দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। বিভিন্ন প্রয়োজনে দলীয় নেতা কর্মীরা তার কাছে ছুটে যেত এবং তিনিও মায়ের স্নেহ দিয়ে সকলকে আগলে রেখেছেন। তার কর্মদক্ষতার কারনে একসময় তাকে বরিশালের রাজনীতি থেকে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে দায়িত্ব্য দেয়া হয়। সেখানেও তিনি সফলভাবে দায়িত্ব্য পালন করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। ছিলেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত থেকে রক্তক্ষয়ী ত্যাগ এবং সক্রিয় থেকে সাংগঠনিক কাঠামো সুসংহত করার পরও তিনি কখনো নিজেকে জনপ্রতিনিধির আসনে বসানোর আকাংখা পোষন করেননি। নির্লোভ, নিরঅহংকার একজন মানুষ ছিলেন সাহান আরা বেগম। তিনি জীবনে রাজনীতি, সামাজিক কর্মকান্ড এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সমানভাবে বিচরন করেছেন। ফলে বরিশালের প্রতিটি স্তরে তিনি অনেক মানুষের অতি আপন একজন ছিলেন। যারা তার মৃত্যুতে শোকে স্তব্দ হয়ে পরেছেন।

বরিশালের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি বরিশালের শত শত অসহায়, দুস্থ মহিলাদের জন্য অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমান বরিশালের অনেক সচ্ছল মহিলাদের অসচ্ছল জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে তিনি পথ দেখিয়েছেন। বরিশালের অনেক মসজিদ মাদ্রাসা নির্মানে তিনি যথাসাধ্য আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। এছাড়া বরিশালের অনেক বেকার যুবককে চাকুরী পেতে সহযোগিতা করেছেন। কখনো ফোনের মাধ্যমে বা সরাসরি কাউকে বলে বেকার যুবকদের চাকুরী পেতে ভূমিকা রেখেছেন। সাহান আরা বেগম যেখানেই কাজ করেছেন সেখানেই তিনি সততা, কর্মদক্ষতা, মানুষের প্রতি অঘাত ভালবাসা দিয়ে সবাইকে জয় করে নিয়েছেন। প্রতিটি অঙ্গনেই তিনি ছিলেন সবার প্রিয় একজন সাহান আরা বেগম।

জীবনের শেষদিকে তার রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম ছিল, ডায়াবেটিক্স নিয়ন্ত্রনের বাহিরে ছিল, হার্টে সমস্যা ছিল। এজন্য তিনি বেশ কয়েকবার দেশে এবং বিদেশে চিকিৎসা করিয়েছেন। চিকিৎসা পরবর্তী তিনি অনেকটা সুস্থ ছিলেন কিন্তু গত ০৫ জুন, ২০২০ ইং তারিখে হঠাৎ তার বুকে ব্যাথা অনুভব হয়। তখন তাকে চিকিৎসার জন্য তৎক্ষনাত পিজি হাসপাতালে তাদের পারিবারিক বরাদ্ধ কেবিনে ভর্তি করা হয়। এরপর তাকে নিবির পর্যক্ষনে রাখা হয়। যদিও প্রথম অবস্থায় তিনি ততটা অসুস্থ ছিলেননা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। একপর্যায় শারিরীক অবস্থা অবনতির শেষ পর্যায়ে পৌছে যায়। অবশেষে গত ০৭ জুন রাত ১১.৩০ টায় সবাইকে কাদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান একজন মহিয়সী নারী, শহীদ জননী সাহান আরা বেগম ( ইন্নাল্লিাহি ওয়াইন্নাইলাইহি রাজিউন)।

সেই সাথে সমাপ্তি ঘটে একজন মহিয়সী নারীর ৭২ বছরের হার না মানা আলোকিত সফল জীবনের। নানান চরাই উৎরাই, রক্তক্ষয়ী ত্যাগ, চোখের সামনে বুলেটের আঘাতে সন্তান হারানোর বেদনা, নিজের শরীরে ঘাতকের বুলেটের আঘাত বয়ে বেড়ান সহ আরো অনেক প্রতিকুলতা ছিল যার জীবনের প্রতিটি স্তরে স্তরে। তার মৃত্যুতে সঙ্গিহীন হলেন দক্ষিন বাংলার রাজনৈতিক অভিবাবক আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ, মাতৃহারা হলেন ৪ সন্তান ( আঞ্জুমান আরা কান্তা, সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ, সেরনিয়াবাত মঈন উদ্দিন আব্দুল্লাহ, সেরনিয়াবাত আশিক আব্দুল্লাহ)। আওয়ামী লীগ হারাল একজন ত্যাগী দক্ষ সৈনিক , দলীয় নেতা কর্মীরা হারাল মায়ের স্নেহ দেয়া একজন অভিবাবক, বরিশালবাসী হারাল একজন অতি আপন মানুষ কে। যাকে বরিশালবাসী কোনদিন ভুলতে পারবেনা। তিনি চীরজীবন বরিশাল বাসীর হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।

সাহান আরা বেগমের মৃত্যুতে বরিশাল সহ সমস্ত রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গন শোকের ছায়া নেমে আসে। স্তব্দ হয়ে পরে চারিদিক। বুক ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পরেন প্রতিটি মানুষ। তার মৃত্যুর পর ৭ জুন রাতে ঢাকায় প্রথম জানাযা এবং ৮ জুন সকালে বরিশালে দ্বিতীয় জানাযা শেষে, গার্ড অব অর্নার প্রদান করে বরিশাল মুসলিম গোরস্থানে তাকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়।

তার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ জাতিয় সংসদে বাজেট অধিবেসনের শুরুতে শোক প্রকাশের সময় প্রধানমন্ত্রী তার রক্তক্ষয়ী জীবন, ১৫ আগষ্টের প্রতক্ষ্যদর্শী ও সন্তানহারনোর কথা, দীর্ঘদিন শরীরে বুলেটের আঘাত নিয়ে জীবন যাপন করা সহ তার ত্যাগী জীবনের কথা উল্লেখ করেন এবং সবাইকে তার জন্য দোয়া করতে বলেন।

আমরাও দোয়া করি, মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন তাকে জান্নাত দান করুন।