সর্বশেষঃ

হারিয়ে গেছে, খুঁজে পাব না

বাংলা পপ ও ব্যান্ড সংগীতের অগ্রপথিক তিনি। দেশের সবার কাছে তিনি গুরু আজম খান নামে পরিচিত। তার গানের বিশেষত্ব ছিল পশ্চিমা ধাঁচের পপগানে দেশজ বিষয়ের সংযোজন ও পরিবেশনার স্বতন্ত্র রীতি। মুক্তিযোদ্ধা এই শিল্পীর আজ নবম প্রয়াণ দিবস।

বিশেষ এদিনে তার জীবনের বিভিন্ন বাঁক নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

বাংলা পপ সংগীতের পথিকৃৎ

সত্তর দশকের একেবারে শুরুতে অর্থাৎ যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে লাকী আখন্দ, হ্যাপী আখন্দ, নিলু, মনসুর এবং সাদেককে নিয়ে গড়ে তোলেন ব্যান্ডদল ‘উচ্চারণ’। তার পরের বছর বিটিভিতে ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ ও ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি সরাসরি প্রচারিত হলে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রশংসা আর তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। তবে ১৯৭৪ সালে ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’ শিরোনামের সাড়া জাগানো গান গেয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক হৈচৈ ফেলে দেন এই কিংবদন্তি পপ কিং। সেই সময় ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ এবং পিলু মমতাজের সঙ্গে বেশ কয়েকটা জনপ্রিয় গানও করেন এই পপগুরু। তাকে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মতো কিছুই নেই। তিনি বাংলা পপ সংগীতের পথিকৃৎ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আজম খান। দীর্ঘদিন দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ২০১১ সালের ৫ জুন (আজ) ঢাকাস্থ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাংলার সংগীত জগতের এই মহান পপতারকা ।

হারিয়ে গেছে, খুঁজে পাব না

বাংলা পপ ও ব্যান্ড সংগীতের অগ্রপথিক তিনি। দেশের সবার কাছে তিনি গুরু আজম খান নামে পরিচিত। তার গানের বিশেষত্ব ছিল পশ্চিমা ধাঁচের পপগানে দেশজ বিষয়ের সংযোজন ও পরিবেশনার স্বতন্ত্র রীতি। মুক্তিযোদ্ধা এই শিল্পীর আজ নবম প্রয়াণ দিবস।

বিশেষ এদিনে তার জীবনের বিভিন্ন বাঁক নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

বাংলা পপ সংগীতের পথিক

আজিমপুর কলোনির সেই মাহবুবুল হক খান

পুরো নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান। কিন্তু মানুষ জানত আজম খান নামেই। ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০ সালে ঢাকার আজিমপুরের ১০নং কলোনিতে জন্ম। তার বাবার নাম আফতাবউদ্দিন আহমেদ, মা জোবেদা খাতুন। বসবাস করতেন বাবার কমলাপুরের বাড়িতে। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা বাবা, মা এবং চার ভাই ও এক বোনের সঙ্গে। বাবা ছিলেন সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ১৯৫৬ সালে কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে শিক্ষাজীবনের শুরু। ১৯৬৮ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। কিছুদিন পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় আর পড়ালেখায় অগ্রসর হতে পারেননি।

গর্বিত এক বীর মুক্তিযোদ্ধা

বাবার অনুপ্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন আজম খান। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি হেঁটে আগরতলা চলে যান। তার গাওয়া গান প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণ জোগাতো। যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেন। ‘২০ আগস্ট, ১৯৭১ একটা তাঁবুতে আলো জ্বলছে, আর সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর : হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশÑ বুঝলাম আজম খান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গলা। আবার অন্যদিকে ভীষণ সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।’Ñ শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে এভাবেই পপগুরু আজম খানকে খুঁজে পাওয়া যায়।

পপগুরু যখন সেকশন কমান্ডার

আজম খান ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইনচার্জ। সেকশন কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন। আজম খান যাত্রাবাড়ী-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান। তার নেতৃত্বে সংঘটিত ‘অপারেশন তিতা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অপারেশনের লক্ষ্য ছিল ঢাকার কিছু গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান রূপসী বাংলা হোটেল) এবং হোটেল পূর্বাণীর গ্যাস সরবরাহে বিঘœ ঘটানো। কারণ ওই সব হোটেলে অবস্থানরত বিদেশিরা যাতে বুঝতে পারে এ দেশে একটা যুদ্ধ চলছে। তাদের লক্ষ্য, ওই সব হোটেলে অবস্থানরত বিদেশিরা যাতে বুঝতে পারে যে দেশে একটা যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে তিনি তার বাম কানে আঘাতপ্রাপ্ত হন।

শোবিজ অঙ্গনেও অসামান্য প্রতিভা

পপগুরু আজম খানকে গানের বাইরে মাঝে মাঝে দেখা গেছে অন্য ভূমিকায়। কখনো অভিনেতা, কখনো বা মডেল, কখনো আবার ক্রিকেটার হিসেবে। শাহীন-সুমন পরিচালিত ‘গডফাদার’ নামের একটি ছবিতে নাম ভূমিকায় খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আজম খান। পরবর্তীতে আরও ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পেলেও তা গ্রহণ করেননি। এছাড়াও আজম খান মডেল হয়েছেন এনার্জি ড্রিংক আর বাংলালিংকের দুটি বিজ্ঞাপন চিত্রে। বিটিভির একাধিক নাটকে বাউল চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন।

বয়স্ক ক্রিকেটার হিসেবে অনন্য রেকর্ড

ক্রিকেটার হিসেবে আজম খান তৈরি করে গেছেন এক অনন্য রেকর্ড। তিনি দেশের বয়স্ক ক্রিকেটার হিসেবে ৪১ বছর বয়স থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত একটানা ১০ বছর ক্রিকেট খেলেছেন। ক্রিকেটে আজম খান ছিলেন একজন অলরাউন্ডার। গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন ।

দেশের প্রথম পপতারকা

বাংলাদেশের প্রথম পপতারকা আজম খান। বাংলাদেশের পপ ও ব্যান্ড সংগীতের অগ্রপথিক। তার পথ অনুসরণ করে ব্যান্ড সংগীত বর্তমানে বাংলাদেশে একটি শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে আজম খান ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসংগীত প্রচার করেন।

বাংলা গানের ইতিহাসে প্রথম হার্ডরক

এই মহান সংগীত তারকা বন্ধু ইশতিয়াকের পরামর্শে সৃষ্টি করেছিলেন একটি এসিড-রক ঘরানার গান ‘জীবনে কিছু পাবো না এ হে হে!’ বাংলা গানের ইতিহাসে- এটিই প্রথম হার্ডরক হিসেবে চিহ্নিত।

রকস্টারদের পথদ্রষ্টা

‘গুরু’ নামে আশির দশকের তরুণদের কাছে পরিচিত নাম আজম খান। তার পথ ধরেই পরে এসেছেন হামিন, শাফিন, মাকসুদ, জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, হাসান, বিপ্লবসহ আরও অনেকেই।

পপগুরুর জনপ্রিয় যেসব গান

তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- ‘আমি যারে চাইরে’, ‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’, ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘একসিডেন্ট’, ‘অনামিকা’, ‘অভিমানী’, ‘আসি আসি বলে’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘পাপড়ি’, ‘বাধা দিও না’, ‘যে মেয়ে চোখে দেখে না’ ইত্যাদি।

ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে অন্তিম শয্যায়

একুশে পদকপ্রাপ্ত গায়ক আজম খান ২০১০ সাল থেকে মুখগহ্বরের ক্যান্সারে ভোগেন। এ জন্য দুবার তাকে সিঙ্গাপুরে নিয়েও চিকিৎসা করানো হয়। দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে পরিশেষে অন্তিম শয্যায় শায়িত হন এই পপগুরু ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিংবদন্তি এই সংগীত তারকার প্রয়াণের নবম বছর হলো। জানি হারিয়ে গেছ, ফিরে পাব না… তবুও তিনি অবিনশ্বর; চিরভাস্বর বাংলা সংগীত ভুবনে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *